২ জানুয়ারি ২০২৩, সোমবার, ১০:৩৯

পণ্যের দাম এবং মানুষের আয় ও মজুরি প্রসঙ্গে

-আশিকুল হামিদ

শীতের সময় সবজির দাম সাধারণত কম থাকলেও এবছর অন্য সকল নিত্যপণ্যের সঙ্গে সবজিও মানুষের কষ্টের কারণ ঘটিয়ে চলেছে। দ্রুত বেড়ে চলা পণ্যমূল্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ জনগণ যখন প্রতিকারের তথা দাম কমানোর জন্য অনেক আশা নিয়ে সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে তেমন এক কঠিন সময়ে চালের দামও জনগণকে হতাশই করে চলেছে। নিত্যপণ্যের অস্থির বাজারে প্রতিদিন বাড়ছে চালের দাম। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, অন্য সকল স্থানে তো বটেই, এমনকি ‘দেশের শস্য ভান্ডার’ নামে পরিচিত দিনাজপুরেও চালের দাম বাড়ছে। রাজধানীসহ সারাদেশের চালের বাজারেও একই অবস্থা চলছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় পাঁচ-সাত কেজি চাল কিনতেও নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। ফলে মাছের প্রশ্ন ওঠে না, প্রয়োজন মতো সবজিও কিনতে পারছে না তারা।

চালের দাম বাড়ার জন্য সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চালের ক্ষুদে ব্যবসায়ীরাও মিল মালিকসহ চালের বড় ব্যবসায়ীদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। তারা চালের মজুদ গড়ে তোলার অভিযোগ এনে বলেছেন, সরকারের উচিত বড় ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ডের প্রতি কঠোর নজরদারি করা এবং তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। এই দাবির জবাবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চোরাচালানী ও মজুতদারদের সতর্ক করে বলেছেন, গত বছর আম্ফানে ফসলের ক্ষতি হলেও চালের দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু চলতি বছর একদিকে ফলন ভালো হয়েছে এবং অন্যদিকে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলেরও ক্ষতি হয়নি। একই কারণে চালের সংকট বা মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যারা দাম বাড়ানোর কর্মকান্ডে যুক্ত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার।

ওই মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে এ বছরের উৎপাদন এবং সরকারের পক্ষে ধান কেনা ও সংগ্রহ করাসহ ধান-চালের অবস্থা সম্পর্কেও অবহিত করেছেন। মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, সরকারের হাতে যে পরিমাণ মজুদ রয়েছে তার ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, চালের সংকট যেমন হবে না তেমনি চালের দাম বাড়ানোরও কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এমন অবস্থায়ও কোনো চক্র যদি সংকট সৃষ্টি করে চালের দাম বাড়ানোর অশুভ কার্যক্রম অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্দেশে সরকারও বিদেশ থেকে চাল আমদানি করবে।
আমরা অবশ্য মনে করি না যে, মূল্যবৃদ্ধি রোধের জন্য চালের আমদানি কোনো সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে। এর ফলে বরং জটিলতা আরো বাড়বে এবং পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নতুন নতুন সিন্ডিকেট গড়ে উঠবে। আমরা তাই আমদানির মতো ঝুঁকিপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ নেয়ার পরিবর্তে যথাযথ মনিটরিং করার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। সব মিলিয়ে এমন ব্যবস্থা নেয়া দরকার, যাতে কোনো মহল বা সিন্ডিকেটের পক্ষে যথেচ্ছভাবে চালের দাম বাড়ানো সম্ভব না হয়। যাতে চালের দাম সাধারণ মানুষের সাধ্যের ভেতরে চলে আসে।

একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করেছেন চালকলের মালিকরাও। গতকাল, পহেলা জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিউিট ব্রি’র গবেষণা রিপোর্টের মূলকথায় জানানো হয়েছে, দেশে বর্তমানে চালের কোনো সংকট বা ঘাটতি নেই। শুধু তা-ই নয়, আগামী কয়েক মাসেও চালের কোনো সমস্যা হবে না। বরং চাহিদা মেটানোর পরও ৪২ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও দাম বাড়ার কারণ, চালকলের মালিক ও খুচরো বিক্রেতারা প্রতি কেজিতে ৮ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করছে। আর সে কারণেই একদিকে দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে চাল ডাল তেল আটা পেঁয়াজ গুঁড়ো দুধ এবং চিনিসহ সব পণ্যেরই অস্বাভাবিক হারে দাম বেড়ে চলেছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়েছে এমনকি ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত। সরকারের বাণিজ্য সংক্রান্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ Ñ টিসিবি’র এবং ট্যারিফ কমিশনের তথ্য উল্লেখ করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, গত কয়েক মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। এসবের মধ্যে মোটা চালের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে বেড়েছে ৩৮ শতাংশ, চিনি বেড়েছে প্রতি কেজিতে ২৬ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৩০ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং আমদানিকৃত রসুনের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত। উল্লেখযোগ্য অন্য পণ্যগুলোর মধ্যে কোনো কোনো ব্রান্ডের সয়াবিন তেল তো বাজার থেকেই হাওয়া করে ফেলেছিল গোষ্ঠীটি।
এভাবে প্রায় সকল নিত্যপণ্যেরই দাম বেড়েছে। এখনও বাড়ানোর কর্মকান্ড চলছেই। এমন অবস্থায় দাম কমানোর কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা নেয়ার এবং সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস দেয়ার পরিবর্তে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা নানা পরিকল্পনার কথা শুনিয়ে চলেছেন। সরকার নাকি আমদানিকৃত পণ্যের ভ্যাট কমানোর চিন্তা করছে এবং এর ফলে নাকি কোনো কোনো পণ্যের দাম কমে যাবে! একই তথ্য জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি আবার শুনিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমদানি শুল্ক স্থগিত রাখার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ দেয়া হলেও আরও কয়েক মাস নাকি মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে! মিস্টার টিপু মুনশি কিন্তু সয়াবিন বা ভোজ্য তেলের ধারে-কাছেও যাননি। তিনি বলেছেন, সরকার বিশেষ করে পেঁয়াজের দাম কমানোর জন্য চেষ্টা করছে! মন্ত্রী বলেছেনও এমনভাবে, যা শুনে মনে হবে যেন ভাত বা রুটি নয়, পেঁয়াজ খেলেই মানুষের পেট ভরে যাবে! মিটবে তাদের ক্ষুধাও!

অন্যদিকে সরকারের এ ধরনের চিন্তা ও কার্যকলাপের কারণে তথ্যাভিজ্ঞরা আশংকা করছেন, অনতিবিলম্বে পণ্যমূল্য কমিয়ে না আনা গেলে নি¤œবিত্তসহ সাধারণ মানুষের কষ্ট সকল সীমা ছাড়িয়ে যাবে। কারণ, করোনার প্রভাবে মানুষের আয়-রোজগার এমনিতেই অনেক কমে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং সরকারের উচিত আমদানি শুল্ক কমানো এবং স্থগিত রাখাসহ সকল পন্থায় পণ্যের মূল্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করা। নাহলে দ্রুত বেড়ে চলা মূল্যের চাপে মানুষের নাভিশ্বাস তো উঠবেই, এমনকি অনাহারেও বহু মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। যদিও মিডিয়ার ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে সেসব তথ্য প্রচারিত হতে পারছে না।

তথ্যাভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, সন্দেহ নেই, সুপরিকল্পিতভাবেই নিত্যপণ্যের বাজারে সংকটের সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের উচিত অবশ্যই লক্ষ্য রাখা, জনগণকে সত্য জানানো এবং প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সংকটের সময় সরকারকে তেমনভাবে তৎপর হতে দেখা যায়নি বললেই চলে। আর সে কারণেই বিভিন্ন সিন্ডিকেট মানুষকে বিপন্ন করতে পেরেছে। বলা বাহুল্য, এমন অবস্থা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে দেয়া যায় না।

ওদিকে জনগণের অবস্থাও যেমন হওয়ার ঠিক তেমনই হচ্ছে। দ্রুত বেড়ে চলা মূল্যের পাশাপাশি চাকরি না থাকার এবং আয়-রোজগার অনেক কমে যাওয়ার কারণেও জনগণকে আজকাল একদিকে কোথায় কম দামে পণ্য পাওয়া যায় সে খোঁজ-খবর করতে হচ্ছে, অন্যদিকে একই মানুষ আবার সস্তায় পণ্য কেনার জন্য ট্রাকের পেছনে গিয়ে লাইনেও দাঁড়াচ্ছে। এগুলো টিসিবিরÑ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের ট্রাক। এসব ট্রাকে করে চাল ডাল সয়াবিন তেল চিনি ও পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি বিশেষ পণ্য কিছুটা কম দামে কিন্তু নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করেছে সরকার।

গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে, টিসিবির পণ্যগুলো বিশেষ কোনো দোকান বা বাজারের পরিবর্তে রাজধানীর দেড়-দুইশ’ পৃথক এলাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। মানুষের বেশি ভিড় যাতে না হয় সে জন্য টিসিবি এক-একদিন এক-এক এলাকায় পণ্যবোঝাই ট্রাক নিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে আগে থেকে কোনো প্রচারণা চালানো না হলেও ঠিকই জানাজানি হচ্ছে এবং প্রতিটি এলাকাতেই মানুষের ভিড় জমে উঠছে। বেলা দশটা থেকে বিক্রি শুরু করার কথা থাকলেও শত শত মানুষ হাজির হচ্ছে ভোর ছয়টার দিক থেকে। একযোগে শুরু হচ্ছে পণ্যের জন্য কাড়াকাড়ি। ফলাফলও যা হওয়ার ঠিক সেটাই হচ্ছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে করে আনা পণ্য ফুরিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় বেলা ১১টারও আগেই ট্রাকের পণ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং আগত বেশির ভাগ মানুষই খালি হাতে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সংকটের মধ্যে অন্য কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ও আশংকাজনক তথ্যও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এরকম একটি তথ্য হলো, গরীব ও নি¤œ আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চ আয়ের বহু মানুষও টিসিবির ট্রাকের চারদিকে ঘিরে দাঁড়াচ্ছে। তাদেরও আশা ও উদ্দেশ্য সস্তায় পণ্য পাওয়া। পর্যবেক্ষকরা কিন্তু বিষয়টিকে দুর্ভাগ্যজনক এবং মর্মান্তিক না বলে পারছেন না। ইতিহাস সম্পর্কে যারা জানেন, তারা এর মধ্যে দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসও লক্ষ্য করতে শুরু করেছেন। বলা হচ্ছে, ১৯৭৪ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকেও এমন অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ের সরকার পরিস্থিতি মোকাবেলার উদ্দেশ্যে বঙ্গভবন, রাজউক এবং বায়তুল মোকাররমসহ মতিঝিলের আশপাশে অভাবী মানুষ এবং রাস্তার কুকুরগুলোকে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর তাদের পরিণতি সম্পর্কে জানা যেতো না।

সে অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই বলা হচ্ছে, বর্তমান বাংলাদেশেও এমন অবস্থার কবলে মানুষ পড়েছে যখন আর তার লজ্জা-শরমের বালাই রখতে পারছে না। যেমন প্রথম কিছুদিন পর্যন্ত নারীরা বোরকার এবং পুরুষরা চাদর ও মুখে মাস্কের আড়াল নিলেও দিন-মাস পেরোনোর এবং করোনার সংক্রমণ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই লাজ-লজ্জা ঝেড়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, দরকার এখন যে কোনো পন্থায় বেঁচে থাকা এবং স্ত্রী-সন্তান ও বৃদ্ধ পিতা-মাতাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা।

ওদিকে এরই মধ্যে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। সরকারের উচিত মূল্য কমানোর পাশাপাশি বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা। বিক্রির ব্যাপারে টিসিবির সঙ্গে আরো কিছু সংস্থাকে যুক্ত করা যায় কি না সেকথাও ভেবে দেখা দরকার। দুর্ভিক্ষের অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সময় একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই সরকারের উচিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া, যাতে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আর ঘটতে না পারে এবং যাতে পণ্যের মূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসে। পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি সিন্ডিকেটে জড়িতদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বলা দরকার, শুধু পণ্যের মূল্য কমিয়ে আনলে চলবে না, সরকারকে একই সঙ্গে মানুষের চাকরির এবং আয়-রোজগার বাড়ানোর জন্যও ব্যবস্থা করতে হবে।

https://dailysangram.com/post/512424