১ জানুয়ারি ২০২৩, রবিবার, ১০:২১

চরম হুমকিতে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা

৭৫ শতাংশ আবাদযোগ্য জমি উর্বরতা হারিয়েছে প্রতি বছর কৃষিজমির পরিমাণ কমছে ১৭০ একর প্রতি বছর অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে ১৭২ একর  ১১ বছরে আবাদি জমি কমেছে ৪ লাখ একর

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: দেশে উদ্বেগজনক হারে কমছে কৃষি জমির পরিমান। বর্তমান সরকারের সময়ে
গত ১১ বছরে (২০০৮-২০১৯) আবাদি জমির পরিমান কমেছে ৪ লাখ একর। বিভিন্ন গবেষণা তথ্য বলছে,
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ আবাদযোগ্য জমি উর্বরতা হারিয়েছে। এতে কমে গেছে ফসলের
উৎপাদন। এছাড়া প্রতিবছর কৃষি জমির পরিমান কমছে ১৭০ একর। একইসাথে প্রতি বছর আবাদি জমি
অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে ১৭২ একর জমি। ফলে চরম হুমকিতে দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা।  
তথ্য বলছে, দেশে গড়ে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টনের বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়। জিডিপিতে এখনও কৃষির
অবদান ৪ শতাংশ। কৃষিতে দেশের ৪০ শতাংশ শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। কৃষি উৎপাদনের ওপর দেশের
অর্থনীতির ভালো-মন্দ নির্ধারিত হয়ে থাকে। অথচ জলবায়ুর প্রভাবে নদী ভাঙন, লবণাক্ততা, নগরায়ন,
ইটভাটা, শিল্পকারখানা, বসতভিটা, রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ ও যত্রতত্র বসতি প্রতিষ্ঠার কারণে
সারা দেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর (১ হেক্টর = ২.৪৭১০৫ একর) আবাদি জমি অকৃষি খাতে
চলে যাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিদিন ২ শতাংশ কৃষিজমি অনাবাদি হচ্ছে।  

বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের
আবাদযোগ্য জমির ৭৫ ভাগ জমির উর্বরতা শক্তি আগের চেয়ে কমে গেছে। চাষযোগ্য প্রয়োজনীয়
নাইট্রোজেনের সংকট রয়েছে। ফসলি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা দরকার সেখানে দেশের
বেশির ভাগ কৃষি জমিতে জৈব উপাদান ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। এমন বাস্তবতায় উৎপাদন বৃদ্ধির
পরিকল্পনা গ্রহণ করার তাগিদ কৃষিবিজ্ঞানীদের। কৃষি বিভাগের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে
আবাদযোগ্য জমি রয়েছে ৮৮ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। আর ৪ লাখ ৩১ হাজার হেক্টর জমি এখনো অনাবাদি
রয়েছে। সামান্য উদ্যোগ নিয়েই এসব জমি আবাদের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। অথচ যুগের পর
যুগ এসব জমি অনাবাদি থাকছে। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ‘বাংলাদেশের কৃষিজমি বিলুপ্তির
প্রবণতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি বছর ১৭২ একর আবাদি জমি অকৃষি খাতে
চলে যাচ্ছে। শুধু অবকাঠামো নির্মাণ কাজের কারণে প্রতি বছর ৩ হাজার হেক্টর জমি হারিয়ে যাচ্ছে।
জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন ২০১০ অনুসারে কৃষিজমি
কৃষিকাজ ব্যতীত অন্যকোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কৃষিজমি
ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্পকারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা করছে মানুষ। ঝুলে আছে

কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন। ভূমি ও কৃষিজমি রক্ষায় রাষ্ট্রের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা
নেই। যা বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। 

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, প্রতি বছর দেশের কৃষিজমির পরিমাণ কমছে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর,
অর্থাৎ প্রতি বছর শতকরা এক ভাগ হিসাবে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাছে। বর্তমান হারে ভূমি
অবক্ষয় চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে কোনো কৃষিজমি থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ
করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি ১ লাখ
৫৭ হাজার একর বা ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। মোট জনসংখ্যা হিসাবে, মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ
দাঁড়ায় প্রায় শূন্য দশমিক ৪৪ হেক্টরে। ঘরবাড়ি, সড়ক নির্মাণসহ নানা কারণে প্রতি বছর দেশের প্রায়
৮০ হাজার হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও কৃষিজমির পরিমাণ
যে হারে কমছে, তাতে অচিরেই কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কৃষিজমি ভরাটের ফলে
প্রতিদিন মোট কৃষিজমি কমছে ৯৬ বিঘা। তামাক চাষের কারণে প্রতিদিন ৯ হাজার একর কৃষিজমির
উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা চরম
হুমকির সম্মুখীন হবে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা অক্সফ্যামের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্যশস্যের দাম ২০৪০ সালে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়বে। এতে গরিব মানুষের
পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।  

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত কৃষি শুমারি রিপোর্ট ২০১৯-এর তথ্য
অনুযায়ী, ১১ বছরে সারা দেশে নিট আবাদি জমি প্রায় ৪ লাখ একর কমেছে। ২০০৮ সালে ফসলি জমির
পরিমাণ ছিল ১.৯ কোটি একর, ২০১৯ সালে এই পরিমাণ কমে ১.৮৬ কোটি একরে নেমে এসেছে। দেশে নিট
আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১.৮৬ কোটি একর। এর মধ্যে অস্থায়ী আবাদি জমি ১.৬৪ কোটি একর এবং
স্থায়ী আবাদি জমির পরিমাণ মোট ১৯.৭০ লাখ একর। দেশে এখন কৃষি খানার সংখ্যা এক কোটি ৬৮ লাখ
৮১ হাজার, যাদের অধীন আবাদি জমি রয়েছে এক কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার একর। তবে ১১ বছরের
ব্যবধানে দেশের মোট আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে চার লাখ ১৬ হাজার একর। এ হিসাবে গড়ে প্রতিবছর
কৃষিজমি কমছে ৩৭ হাজার ৮১৮ একর। অন্যদিকে কৃষি খানার পরিচালনাধীন মোট জমি (আবাদি ও
অনাবাদি) জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। 

দেশের কৃষি পরিবারে পরিচালনাধীন মোট জমি বা কৃষি পরিবারগুলোর মালিকানায় যে জমি রয়েছে তার
পরিমাণ হলো দুই কোটি ২৯ লাখ ৭৫ হাজার একর, যা ২০০৮ সালের শুমারিতে ছিল দুই কোটি ৩৫ লাখ পাঁচ
হাজার একর  (১ একর = ৩.০২৫ বিঘা)। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, কৃষি পরিবারগুলোর পরিচালনাধীন জমির
পরিমাণ কমে গেছে প্রায় পাঁচ লাখ ৩০ হাজার একর। অন্যদিকে নিট আবাদি জমির পরিমাণ ২০১৯ সালে
কমে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার একর, যা ২০০৮ সালে ছিল এক কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার।
ফলে ১১ বছরে কৃষিজমি কমেছে চার লাখ ১৬ হাজার একর। প্রতিবছরে আবাদি জমি কমেছে প্রায় ৩৭
হাজার ৮১৮ একর করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে বছরে মাত্র এক বার আবাদ হয়, এমন জমি রয়েছে ২১ লাখ ১০ হাজার
হেক্টর। আর বছরে দুই বার আবাদ হয় এমন জমির পরিমাণ ৪১ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর। আর তিন বার
আবাদ হয় এমন জমি ১৮ লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর। চার ফসলি জমি ১৭ হাজার হেক্টর।  

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ভূমির মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এখন
৭৯ দশমিক ৪৬ লাখ হেক্টর। এর ৫৩ শতাংশই দুই বা তিন ফসলি জমি। অবকাঠামো নির্মাণ, ইটভাটা,
কলকারখানার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করায় দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি
অকৃষি কাজে চলে যাচ্ছে। অথচ জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০ এবং কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং
আইন ২০১০ অনুসারে, কৃষিজমি কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। 
সার্বিক বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন জানান, বাংলাদেশে প্রতি বছর
প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ
বাংলাদেশে কোনো কৃষিজমি থাকবে না। জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়লেও কৃষিজমি বাড়ছে না।   ১৯৭১ সালে
দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৫৮ হাজার
হেক্টরে। 

বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক কৃষি অর্থনীতিবিদ ডক্টর নজরুল জানান, আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশে
কৃষিই মানুষের মূল জীবিকা। মানুষ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়িঘরও বাড়ছে, বাড়ছে কলকারখানা বা অন্যান্য
অনুষঙ্গও। কিন্তু সেই বাড়তি মানুষের খাদ্য আসবে কোথা থেকে? জমি তো কমছে। 
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক জানান, কৃষিজমি কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। মানুষ
যেখানে সেখানে বসতবাড়ি ঘরে তুলছে। সড়ক ও জনপদ নির্মাণে বহুলাংশেই কৃষি জমি ব্যবহার হচ্ছে।

https://dailysangram.com/post/512399