৩১ ডিসেম্বর ২০২২, শনিবার, ৩:২৬

থার্টি-ফার্স্ট নিয়ে যতকথা

-ইবনে নূরুল হুদা

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসাবে আমাদের জন্য অপরিহার্য করে দিয়েছেন। মানবজীবনে এমন কোন সমস্যা নেই যার সমাধান ইসলামে নেই। পবিত্র কালামে হাকীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতসমূহ সম্পূর্ণ করলাম এবং আমি তোমাদের দ্বীন ইসলামের প্রতি সন্তুষ্ট রইলাম।’ (সুরা আল মায়িদা-৩) মূলত, মানবজীবনের এমন কোন সমস্যা নেই যার সমাধান ইসলাম দেয়নি। ইসলাম মানবজীবনের সকল কিছুকেই সংবিধিবদ্ধ করে দিয়েছে। তাই মানুষের পক্ষে স্বেচ্ছাচারি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শুধুমাত্র তাঁর আনুগত্য করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি জ¦ীন ও মানবজাতিকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। (সুরা জারিয়াত-৫৬) তাই মানুষের পক্ষে আল্লাহর নির্ধারিত সীমার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

আল্লাহ যেমন কারো মুখাপেক্ষী নন ঠিক তেমনিভাবে তিনি তার দ্বীনকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। খুব সঙ্গত কারণেই ইসলামী তাহজীব-তামুদ্দন, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বোধ-বিশ্বাস, আদর্শ-মূল্যবোধে নিজস্ব স্বকীয়তা রয়েছে। যা অপরাপর ধর্ম ও জাতির কৃষ্টি-সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু দীর্ঘকালের পরিক্রমায় ইসলামের মধ্যে কিছু রসম-রেওয়াজ ও কথিত সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির প্রচলন হয়েছে যার সাথে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধের দূরতম সম্পর্ক নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব সামাজিক নিয়ম হিসেবে প্রচলিত আছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে সেসব বিভিন্ন ধর্ম থেকে মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে অনুপ্রবেশ করে এমনভাবে মুসলমানদের জীবনাচরণের সাথে মিশে গেছে যে অনেকেই অজ্ঞতাবশত এগুলোকে ইসলামী ঐহিত্য ও সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে মনে করেন।

মূলত ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে মোহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযান ও সিন্ধুরাজ দাহিরের পতনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের আগে উপমহাদেশের সিংহভাগ মানুষই ছিল বৈদিক বা সনাতন ধর্মের অনুসারী। আর এই প্রতিকূল পরিবেশেই ইসলামের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনেক রসম-রেওয়াজই মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ ঘটে। যেমন বর্ষবরণ, নবান্ন উৎসব, রাখি বন্ধন, গায়ে হলুদ, অষ্টমঙ্গল, বরমূল্য যা বিবাহের যৌতুক হিসেবে মুসলিম সমাজে প্রচলিত আছে। বস্তুত, এসব মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্মারক নয় বরং বিজাতীয় সংস্কৃতির অংশ। যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান তাই অন্য ধর্ম ও জাতির ঐতিহ্য-সংস্কৃতি থেকে কোন কিছু ধারকর্জ করা কোন ভাবেই কাক্সিক্ষত ও গ্রহণযোগ্য নয় বরং তা অবশ্যই গর্হিত কাজ। কোন মুসলমান ভিন ধর্মীয় বা বিজাতীয় কোন সংস্কৃতি, উৎসব বা ঐতিহ্যের প্রতিভূ হতে পারে না। কারণ, ইসলাম আমাদেরকে এ বিষয়ে সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাই সেই সীমারেখা অতিক্রমের কোন সুযোগ নেই।

এ প্রসঙ্গে হাদিসে রাসূল (সা.) এ বলা হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) যখন মদীনায় এলেন, তখন তাদের দু’টো উৎসবের দিন ছিল। তিনি বললেন, ‘এ দুটো দিনের তাৎপর্য কী?’ তারা বলল, ‘জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুটো দিনে উৎসব করতাম।’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে এর পরিবর্তে উত্তম কিছু দিয়েছেন। তাহলো- ইয়াওমুদ্দুহা ও ইয়াওমুল ফিতর।’ (আবু দাউদ) রাসূল (সা.) বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চা থেকে বিরত থাকার জন্য মুসলমানদের কড়া হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। হাদিসের বর্ণনা মতে, ‘সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত। হযরত রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক রাখে, সে তাদের দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।’ (সুনানে আহমদ, সুনানে আবূ দাউদ)

হাদিস শরীফের অপর বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘হযরত জাবির (রা.) রাসূল (সা.) হতে বলেন বর্ণনা করেন যে, একদিন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব (রা) নবী কারীম (সা.) নিকট এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমরা ইয়াহুদীদের থেকে তাদের কিছু ধর্মীয় কথা শুনে থাকি, যাতে আমরা আশ্চর্যবোধ করি। এর কিছু আমরা লিখে রাখবো কি’? রাসূল (সা.) বললেন, ‘তোমরাও কি দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছ? যে রকম ইয়াহুদী-নাসারাগণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে? অবশ্যই আমি তোমাদের নিকট পরিপূর্ণ, উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে এসেছি। হযরত মূসা (আ.) যদি দুনিয়ায় থাকতেন, তাহলে তাঁকেও আমার অনুসরণ করতে হতো।’ (মুসনাদে আহমদ, বাইহাক্বী, মিশকাত, মিরকাত) অতএব মুসলমানদের এমন কোন ক্রিয়া-কর্ম, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও উৎসবের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া সঙ্গত ও বৈধ নয় যা বিজাতীয় ও কুফরী সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত হয়।

মূলত ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও শাহাদাতের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন হয় এবং তা প্রায় ২শ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ইংরেজদের দীর্ঘ শাসন ও শোষণের ফলে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়েছি। তাই আমাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিমী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মানুষের জীবনাচারণ, পছন্দ-অপছন্দ-রুচিবোধ ও পোষাক-আশাকে বৈচিত্র এসেছে। ক্ষেত্রবিশেষে আমরা নিজেদের দ্বীনকে ভুলে গিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছি। গা ভাসিয়ে দিয়েছি ইংরেজী সংস্কৃতির গড্ডলিকা প্রবাহে। এমনই এক পশ্চিমী সংস্কৃতি নামের অপসংস্কৃতি হচ্ছে কথিত ‘থার্টি ফার্ষ্ট নাইট’। যা মুসলিম সমাজে অসার, অনর্থক, বেহুদা ও শয়তানি কাজ হিসেবেই স্বীকৃত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ ধরনের বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকতে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। কালামে হাকীমে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই বিশ্বাসীগণ সফলকাম হয়েছে। যারা নামাযে বিনয়ী-ন¤্র। যারা অসার ক্রিয়া-কলাপ থেকে বিরত থাকে’। সুরা আল মোমিনুন-আয়াত-১-৩। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। তখন তো শয়তান নির্লজ্জতা ও মন্দ কাজেরই আদেশ করবে’। সুরা আন নূর-২১।
মূলত, ইংরেজী নতুন বছরকে বরণ করার জন্য বিদায়ী বছরের শেষ রাত ও নতুন বছরের প্রথম প্রহরে এই উৎসব উদযাপন করা হয়। আসলে এটি কোন মুসলিম ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির অংশ নয়। কথিত বর্ষবরণের এই রাতে নারী-পুরুষদের অবাধ-মেলামেশার সুযোগ করে দেয়া হয়। উৎসবের নামে আতশ ও পটকাবাজি, বেহুদাপনা, মাদকসেবন, উচ্ছৃখলতা, বেহায়াপনা, পথে পথে নারী-পুরুষের উদ্দাম নৃত্য শুধু ইসলামী ঐতিহ্যে নয় বরং কোন সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। অথচ আমাদের দেশসহ মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এই বিজাতীয় সংস্কৃতি ও ফিৎনার এমনভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে যা থেকে পরিত্রাণ লাভ করার আপাত কোন সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না। মুসলমানরা যদি এখনই এ বিষয়ে আত্মসচেতন না হতে পারেন তাহলে দ্বীনে হকের মধ্যে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটতে ঘটতে একসময় আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিই কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে পারে। তাই এ বিষয়ে প্রতিটি মুসলমানকেই আত্মসচেতন হওয়া উচিত।

মূলত, কথিত থার্টি ফার্ষ্ট নাইট উদযাপনের মাধ্যমে ইংরেজী বর্ষবরণ বিজাতীয়, কুফরী ও মোশরেকী সংস্কৃতির অংশ। এমনকি তা ইসলামী আকিদার সাথেও সঙ্গতিহীন। তাই কোন মুসলমানের বিজাতীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক হওয়ার সুযোগ নেই। অথচ আমরা কেউ অজ্ঞতাবশত আবার কেউ জেনে শুনেই এই গর্হিত কাজটি অবলীলায় করে যাচ্ছি। তাই থার্টি ফার্ষ্ট বা ইংরেজী বর্ষবরণের উদযাপনের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক।

মূলত হযরত ঈসা (আ.) এর জন্মের ৪৬ বছর আগে রোমানরা Janus নামে এক ঈশ্বরের পূজা শুরু করে। যাকে তারা God of beginnings বা শুরুর শ্রষ্ঠারূপে বিশ্বাস করতো। বস্তুত, তারা বহু স্রষ্টায় বিশ্বাসী ছিল। তার মধ্যে Janus ছিল অন্যতম। তাদের বিশ্বাস ছিল Janus অতীত-ভবিষ্যতের সবকিছুই জানেন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন। এই Janus এর নাম অনুসারে বছরের প্রথম মাসের নাম দেয়া হয় January. এই মাসে ঘটা করে তাদের এই ঈশ্বরকে খুশী করে যেন Janus তাদেরকে পুরো বছর মঙ্গলের মধ্যে রাখেন। মূলত, এই Janus পূজা থেকে ইংরেজী বর্ষবরণের সূচনা।

সে ধারাবাহিকতায় একই সময়ে তথা খ্রিস্টপূর্ব ’৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম ইংরেজি নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করেন। মূলত, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে ইংরেজি সনের বিস্তৃতি। পরবর্তীতে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালন শুরু হয়! সাধারণভাবে প্রাচীন পারস্যের সম্রাট জমশীদ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে এই নববর্ষ বা নওরোজের প্রবর্তন করেছিলেন। এ ধারাবাহিকতা এখনো পারস্যে আছে এবং ইরানে নওরোজ ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়। মেসোপটেমিয়ায় এই নববর্ষ শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে। ব্যাবিলনিয়ায় নববর্ষ শুরু হতো ২০ মার্চ। অ্যাসিরিয়ায় শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর।

মিসর ও পারসিকদের নতুন বছর শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। গ্রীকদের নববর্ষ শুরু হতো খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩-এর পরে ১ জানুয়ারিতে। ইয়াহুদিদের নববর্ষ বা রোশ হাসানা শুরু হয় তিসরি মাসের প্রথম দিন। মোটামুটিভাবে তিসরি মাস হচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর। মধ্যযুগে ইউরোপের অধিকাংশ দেশে নববর্ষ শুরু হতো ২৫ মার্চ। অ্যাংলো-স্যাকসন ইংল্যান্ডে নববর্ষের দিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর। পহেলা জানুয়ারি নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে শুধু ইউরোপে নয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন শুরু হয়।

মোঘল সম্ম্রাট আকবরের ফরমান অনুযায়ী আমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজী উদ্ভাবিত বাংলা ফসলি সাল চালু হয় ১০ মার্চ ১৫৬৩ সালে। ইংরেজ আমলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হলেও রাজস্ব আদায়ে ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে বাংলা সাল তথা ফসলি সন বেশি ব্যবহার করা হতো। মজুসী বা অগ্নি উপাসকরা এখনো বর্ষবরণকে সরকারি ছত্রছায়ায় ব্যাপক জাঁকজমকভাবে পালন করে থাকে। একে তারা তাদের ধর্মীয় অনুষঙ্গ মনে করে এবং নওরোজ বা নতুন দিন বলে অভিহিত করে। ফসলি সনের নববর্ষ হিন্দুদের খাছ ধর্মীয় উৎসবের দিন। এর আগের দিন তাদের চৈত্র সংক্রান্তি, আর পহেলা বৈশাখ হলো ঘট পূজার দিন।
মূলত, ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে একমাত্র পরিপূর্ণ, সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত, নিয়ামতপূর্ণ, অপরিবর্তনীয় এবং মনোনীত জীবন বিধান। মানুষের ইহকালীন কল্যাণ, পরকালীন মুক্তি ও হেদায়াতের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। তাই এ দ্বীনের মধ্যে বিজাতীয় কোন ঐহিত্য-সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটানো কোনভাবেই বৈধতা পেতে পারে না। কারণ, ইসলামই হচ্ছে অদ্বিতীয় জীবন বিধান। যারা ইসলামের আওতার মধ্যে নেই তারা নিঃসন্দেহে কাফির-মুশরিকদের অন্তর্গত। তাই কাফির-মুশরিকদের অনুসরণও ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কালামে পাকে বলা হয়ছে, ‘নিশ্চয়ই সমস্ত প্রাণীর মধ্যে আল্লাহ পাকের নিকট কাফিররাই নিকৃষ্ট, যারা ঈমান আনেনি।’(সূরা আনফাল-৫৫) আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, হে মুসলিমগণ! তোমরা ওই জালেমদের দিকে একটুও ঝুঁকবে না, অন্যথায় জাহান্নামের আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে। (সূরা হুদ, ১১৩) আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে ব্যক্তি শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, সে তো অশ্লীলতা ও মন্দেরই নির্দেশ দেবে। (সূরা নূর : ২৯)

উপরের আলোচনা থেকে একথা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বর্ষবরণের নামে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন ও বেলেল্লাপনা ইসলামী আকিদা, বোধ-বিশ্বাস, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পরিপন্থি। তাই ইংরেজী সালের শেষ রাতে তরুণ-তরুণীর অবাধ মেলামেশা, বেহায়াপনা, উন্মত্ত নর্তন-কুর্দন, নেশাগ্রস্ততা, অহেতুক অপচয় ও গান-বাজনা সম্পূর্ণ হারাম। ইসলাম এসব বেহুদাপনাকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে।

ইসলাম নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে কোনভাবেই স্বীকৃতি দেয়নি। আর থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের নামে যা হয় তা যেনা-ব্যভিচারকেই উৎসাহিত করে।
এ সম্পর্র্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ’। (সূরা বনি ইসরাইল-৩২) মূলত বর্ষবরণের নামে নি¤েœাক্ত বিষয়গুলোর প্রসার ঘটে এবং তা মানুষকে বিভিন্ন ধরনের পাপাচারে লিপ্ত হতে সহায়তা করে।

অশ্লীলতা : অশ্লীলতা ও বেহায়াপনাকে ইসলামে গর্হিত ও নিকৃষ্টতম পাপাচার বলে মনে করা হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘ঐসব নারী যারা হবে পোশাক পরিহিতা কিন্তু নগ্ন। যারা পরপুরুষকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের মত। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না।’ সহীহ মুসলিম-২১২৮
গান বাজনা : অশ্লীল গান-বাজনাকে ইসলামে হারাম করা হয়েছে। এ রাতে বর্ষবরণের নামে আয়োজিত হয় বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল কনসার্ট। যেখানে নারী পুরুষের একসঙ্গে গান-বাজনা, নগ্ন নৃত্য আবশ্যকীয় বিষয়। অথচ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ও রাসূল (সা.) এসব নিন্দনীয় কাজকে সম্পূর্ণ হারাম ও অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। যারা এসব কাজে লিপ্ত তাদের জন্য করেছেন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সূরা লুকমান-৬)

আতশবাজি ও পটকাবাজি : এ রাতে আনন্দ-উল্লাস করার জন্য মধ্যরাত থেকে শুরু হয় আতশবাজিও পটকাবাজি। যা জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করে। এর দ্বারা অগ্নিসংযোগেরও আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া এসব কর্মকান্ডে জনসাধারণের কষ্টদায়ক ও বিরক্তিকর হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সূরা আহযাব ঃ ৫৮)
অর্থ অপচয়

এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক অর্থ অনৈসলামিক ও হারাম কাজে ব্যয় করা হয়। যা একদিকে যেমন মারাত্মক গুনাহের কাজ অপর দিকে অপচয়। আর ইসলাম অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের বড়ই অকৃতজ্ঞ। (সূরা বনি ইসরাঈল-২৭)
তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশা : এ রাত্রিতে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, সমুদ্র সৈকত, নাইট ক্লাবে যুবক-যুবতীরা অবাধে মেলামেশা ও অপকর্মে লিপ্ত হয়। যা ইসলামের পরিভাষায় যিনা বা ব্যভিচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হলে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।’ মিশকাত শরীফ : ১৩১৮
মূলত, থার্টি ফার্ষ্ট বা বর্ষবরণের নামে উন্মত্ততার অনুমোদন ইসলামে নেই বরং এসব বিজাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। তাই মুমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনসহ এধরনের সকল বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকা। কথিত বর্ষবরণ বা উৎসবের নামে সকল প্রকার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, হৈ-হুল্লোড় এবং নগ্নতা প্রদর্শনকে এড়িয়ে চলা। কারণ, আল্লাহ মানুষকে জীবন-যৌবনের পূজা করার জন্য জন্য সৃষ্টি করেননি বরং খলিফা হিসেবে তার একচ্ছত্র আনুগত্য করার জন্যই দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। আর মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদাও প্রদান করা হয়েছে।

মূলত, আমল বা কর্মের মাধ্যমেই মানুষকে তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যদা রক্ষা করতে হবে। মানুষ সৎকাজের আদেশ ও অসৎ এবং বেহুদাপনা থেকে বিরত রাখতে হবে। পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত; মানবজাতির কল্যাণ সাধানের জন্য তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে’। (সূরা আল ইমরান-১১০)

https://dailysangram.com/post/512247