তানোরের বনকেশর খালের ওপর নির্মিত সেতু। এর দু’পাশে সড়কের অস্তিত্ব নেই। মঙ্গলবারের ছবি -যুগান্তর
১২ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ১০:৫১

রাজশাহীর চালচিত্র

সড়ক নেই তবু সেতু নির্মাণের ধুম

মানুষ মাঠে যাওয়া-আসা করেন জমির আইল দিয়ে। নেই কোনো সড়ক। তবু সেখানেই নির্মাণ করা হচ্ছে সংযোগ সেতু। রাজশাহীর তানোরে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে খাড়ির ওপর ছয়টি সেতু নির্মাণ কাজের প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের নির্মাণ কাজ সপ্তাহ দু’য়েক আগে শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা। সংযোগ সড়ক ছাড়া শুধু সেতু নির্মাণ করায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাদের বক্তব্য, সড়ক ছাড়া সেতু নির্মাণ অর্থহীন। কারণ নির্মাণাধীন এ সেতু স্থানীয় মানুষের কোনো কাজে আসবে না। সরকারি টাকা লুটপাটের উদ্দেশ্যেই এ ধরনের সেতু করা হচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তানোর উপজেলার চারটি ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় খাড়ির ওপর ছয়টি সেতু নির্মাণে তালিকা প্রস্তুত করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরে পাঠানো হয় গত বছরের আগস্টে। তালিকা মোতাবেক নকশা অনুমোদন করে গত বছরের ৫ অক্টোবর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর দরপত্র আহ্বান করে। ছয়টি সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ২ কোটি ৩১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮৯ টাকা। এর মধ্যে বাঁধাইড় ইউপির গাল্লা প্রকাশনগর এলাকায় খাড়ির ওপর ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সেতু নির্মাণ কাজে ৫৬ লাখ ৮৯ হাজার ১০৬ টাকা ব্যয় ধরা হয়। একই পরিমাণ টাকা ব্যয়ে কলমা ইউনিয়নের বলদিপাড়া মোয়াতলা খাড়ির ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া কলমা ইউনিয়নের বংশীধরপুর খড়খড়ি ঘাটে খাড়ির ওপর ৩০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সেতু নির্মাণ কাজে ২৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯১৫ টাকা ও রামনাথপুর গুটিংপাড়া হতে চকনাকা পর্যন্ত খাড়ির ওপর ৩৪ ফুট সেতু নির্মাণ কাজে ২৭ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৬ টাকা ব্যয় ধরা হয়।

অপরদিকে উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের বনকেশর মরাপাড়ায় খাড়ির ওপর ৪০ ফুট সেতু নির্মাণ কাজে ৩২ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৩ টাকা ব্যয় ধরা হয়। ওই একই পরিমাণ ব্যয়ে উপজেলার সরনজাই ইউনিয়নের বিল্লি খাড়ির ওপর মুকুলের জমির কাছে সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয় কর্তৃপক্ষ। তবে কালভার্ট আকারের এসব সেতুর নির্মাণ ব্যয় দ্বিগুণ ধরা হয়েছে বলে উপজেলা এলজিইডি বিভাগ দাবি করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলজিইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, দ্বিগুণ অর্থ ব্যয়ে সেতুর নামে কালভার্ট নির্মাণ কেন করা হচ্ছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সরেজমিন দেখা গেছে, বাঁধাইড় ইউনিয়নের গাল্লা প্রকাশনগর খাড়ির ওপর ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সেতু নির্মাণ কাজ চলছে। সেতুটি নির্মাণ শুরু হলেও সংযোগ সড়ক নেই। সেতুর মাথায় রয়েছে ধান ক্ষেত।

স্থানীয় বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলছেন, এই সেতুটির পাশে দুশ’ হাত দক্ষিণে ওই একই খাড়ির ওপর সেতু ও সড়ক রয়েছে। যে পরিমাণ টাকা দিয়ে অহেতুক সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে তা দিয়ে এলাকার ভাঙা রাস্তা মেরামত করা যেত। তার দাবি, লুটপাটের জন্যই এ ধরনের প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেছে।

একই অবস্থা কলমা ইউনিয়নের বলদিপাড়া মোয়াতলা খাড়ির ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পে। এই সেতুর দুই পাশে বনবিভাগের বিপুলসংখ্যক ঔষধি ও বনগাছ রয়েছে। এ ছাড়া পাঁচন্দর ইউনিয়নের বনকেশর মরাপাড়া হতে বানিয়াল পর্যন্ত খাড়ির ওপর ৪০ ফুট সেতুর পাশে মরাখাল ও ধান ক্ষেত। এই সেতুর স্থানে নকশায় কোনো সড়ক নেই। একই ধরনের অবস্থা সরনজাই ইউনিয়নের বিল্লি খাড়ির ওপর মুকুলের জমির কাছে সেতু নির্মাণ প্রকল্পে। বনকেশর গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সড়ক ছাড়া সেতু মূল্যহীন। কারণ সড়ক না থাকলে মানুষ সেতু ব্যবহার করতে পারবেন না। জমির আইল দিয়ে কৃষক ও শ্রমিকরা হাঁটেন। তাই সেতু নির্মাণ করা হলেও তা মানুষের কাজে আসবে না।’ একই ধরনের মন্তব্য করেন উপজেলার সরনজাই গ্রামের জালাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সেতু নির্মাণের অজুহাতে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা এবং ঠিকাদাররা সরকারি অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করছেন। এ প্রকল্প সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না।’

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা শেষ হয়েছে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর। এরপর অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারদের মাঝে লটারি করে কার্যাদেশ দেয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারদের অধিকাংশই সরকার সমর্থক দলের নেতাকর্মী।

তবে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের কর্মকর্তা আমিনুল হক জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রতি উপজেলার কারিগরি কমিটি কাজ করেছে। এসব কমিটির সুপারিশের পরই নির্মাণে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। প্রতিটি কারিগরি কমিটিতে রয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলীরা। এ ছাড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নিজেই একজন প্রকৌশলী। সরাসরি তিনিই এসব কার্যক্রম দেখভাল করছেন। এর বাইরে রয়েছে উপসহকারী প্রকৌশলীরাও। ফলে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ কাজ হচ্ছে এমন দাবি অযৌক্তিক।

এ ব্যাপারে তানোর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শওকাত আলী বলেন, ‘এসব কাজের নকশা সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে অনুমোদন দেয়া হয়ে থাকে। তিনি কেবলমাত্র দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন। কোনো ঠিকাদার কাজে অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তবে সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/12/116960/