১২ এপ্রিল ২০১৭, বুধবার, ১০:৪৯

দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে বিডিবিএল

খেলাপি ঋণ ৪৮ শতাংশ, অবলোপন করা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা * এটা যেহেতু সরকারি ব্যাংক, তাই এর দায় সরকারকে নিতে হবে। সরকার যেভাবে ব্যাংক চালাচ্ছে, তাতে পুরো ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর লোকসানে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। যথেচ্ছা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরকারি এ ব্যাংকটি অল্প সময়ের মধ্যে ডুবতে বসেছে। মুখ থুবড়ে পড়েছে সার্বিক কার্যক্রম। এর মধ্যে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এরপরও ব্যাংকটির আদায় অনিশ্চিত খেলাপি ঋণের হার এখন ৪৮ শতাংশের ওপরে। এসব তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে। আর এমন তথ্য পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বেগ জানিয়েছে।


সূত্র জানায়, যদিও বিদায়ী বছরে বিডিবিএলের পরিচালন মুনাফা দেখানো হয়েছে ৬৩ কোটি টাকা, কিন্তু বার্ষিক আয়কর, ঋণখেলাপি ও অবলোপনের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখলে মুনাফা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। ইতিমধ্যে প্রভিশন কমিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দরকষাকষি শুরু করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। খেলাপির বিপরীতে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা কমানোর জন্য নানা তদবিরও চলছে। এ ছাড়া আয়কর দেয়ার পর ব্যাংকের হাতে তেমন কোনো অর্থ থাকবে না।

সূত্রগুলো জানায়, এক শ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের বিডিবিএল এখন ডুবতে বসেছে। অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সরকারবিরোধী হিসেবেও পরিচিত। তা সত্ত্বেও বর্তমান ম্যানেজমেন্টেও তাদের সরব অবস্থান রহস্যজনক। এদের একজন জহিরুল হক বাদল। বর্তমান এমডিকে প্রভাবিত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া একই কাতারে রয়েছেন মোস্তফা কামাল, আবদুল বাকি, এনামুর রহমান সিদ্দিকী ও দিলশাদ হোসেন সিদ্দিকী।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ৫০ শতাংশ খেলাপি ঋণ থাকার অর্থই হল ব্যাংকটির অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, সীমাহীন দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে এমনটি হয়েছে। এটা যেহেতু সরকারি ব্যাংক তাই এর দায় সরকারকে নিতে হবে। সরকার যেভাবে ব্যাংক চালাচ্ছে, তাতে পুরো ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর সুপারভিশনের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু অনিয়ম করলে এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। এটা এক ধরনের কালো আইন। তিনি বলেন, কালো আইন ভাঙতে না পারলে শুধু বিডিবিএল কেন, সরকারি কোনো ব্যাংকের অনিয়ম বন্ধ করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দোষী প্রমাণিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির সুশাসন এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিন্মমানের। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাব রয়েছে। ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম (এমআইএস) অত্যন্ত দুর্বল। ব্যাংকের তদারকি অবস্থা নিন্মমানের। জনসাধারণের আমানতের টাকায় প্রদত্ত ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণের সময় অনেক ক্ষেত্রেই প্রচলিত বিধিবিধান উপেক্ষা করার নজির পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগের পরিদর্শনে উদ্ঘাটিত অনিয়মের পুনরাবৃত্তি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬টি বড় শাখায় ব্যাপক ঋণ অনিয়ম করা হয়। ঋণ দেয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪টির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া বন্ধ পেয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান। এসব শাখায় ২৭টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২৫০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। এ ছাড়া শীর্ষ ২০ খেলাপিসহ বিভিন্ন খেলাপির কাছে আটকে আছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঋণ অবলোপনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। এ সময় আদায় হয়েছে মাত্র সাড়ে ৭৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এ ক্ষতির বিপরীতে সমপরিমাণ প্রভিশন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাখা হয়েছে মাত্র ১৬ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এসব ঋণ অনিয়মের ঘটনায় ব্যাংকের সাবেক কয়েকজন শীর্ষ ও মাঝারি কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিদর্শনে দেখা গেছে, আশুগঞ্জ ও প্রিন্সিপাল শাখায় কোনো ব্যাংকিং হয়নি বরং হয়েছে লুটপাট। আশুগঞ্জ শাখায় এসএমই ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ লুট করা হয়। খাতা-কলমে দেখানো হয়েছে, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়া হয়েছে, কিন্তু পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, ঋণগ্রহীতা নারীরা কোনো উদ্যোক্তা নন। এ ছাড়া আশুগঞ্জ ও প্রিন্সিপাল শাখায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। মেয়াদি ঋণ দেয়া অ্যাকাউন্টে কখনও এক টাকাও লেনদেন হয়নি। অর্থাৎ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ব্যাংকের অর্থ সরানোর জন্য। প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ঋণ দেয়া হয়েছে। এরপর ওইসব ঋণ আদায়ে কোনো তদারকিও ছিল না। অপরদিকে আশুগঞ্জসহ ব্যাংকটির ৮টি শাখা পরিচালকরা নিজের স্বার্থে এবং নিজের এলাকায় খুলেছেন। এসব কারণে সব শাখা লোকসানের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে সাবেক পরিচালক ইসহাক ভূঁইয়ার আশুগঞ্জ শাখায় ঋণ অনিয়ম হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া পরিচালকদের আরও কয়েকটি শাখায় ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে।

জানতে চাইলে বিডিবিএলের বর্তমান চেয়ারম্যান ইয়াছিন আলী যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে সব শাখা খোলা হয়েছে। এখানে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। কয়েকজন পরিচালকের শাখায় ব্যাপক অনিয়মের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলেন।

অনিয়মের আরও কিছু ধরন উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে- কর্মকর্তাদের যোগসাজশে খেলাপি যোগ্য অনেক ঋণ খেলাপি দেখানো হয়নি, প্রকল্প ঋণের সদ্ব্যবহার তদারকিতে চরম ব্যর্থতা, ঋণ বিতরণের দীর্ঘদিন পরও ঋণ পরিশোধসংক্রান্ত হালনাগাদ তালিকা তৈরি না করা, ডাউনপেমেন্ট না নিয়ে/আংশিক ডাউনপেমেন্টের মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিল করা, খেলাপি ঋণের তালিকায় পুনঃতফসিলিকৃত ঋণ হিসেবে পুনঃতফসিলিকরণের সংখ্যা উল্লেখ না করা, শ্রেণীকৃত ঋণ হিসাবে অনাদায়ী সুদ স্থগিত সুদ হিসাবে না নিয়ে আয় খাতে নেয়া, প্রকল্প জামানতের অতিমূল্যায়ন এবং মামলা দায়ের যোগ্য গ্রাহকদের বিরুদ্ধে মামলা না করা। বিডিবিএলের গুরুত্বপূর্ণ পদে অসৎ কর্মকর্তাদের পদায়নের কারণেই এ ধরনের গুরুতর সব অনিয়ম হলেও কার্যত কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ছিল না কোনো মনিটরিং।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/12/116953/