১০ জুন ২০২২, শুক্রবার, ১২:৫১

৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে ঋণের সুদে

প্রতি বছরই বেড়ে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধের ব্যয়। বলা চলে, ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে জাতীয় বাজেট। বাজেটের আকার বড় হচ্ছে। বাড়ছে সরকারের ব্যয়। কিন্তু ব্যয় অনুযায়ী আয় হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে ঘাটতি বাজেট। আর এ ঘাটতি মেটাতে নিতে হচ্ছে ঋণ। এতে প্রতি বছরই ঋণ বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে ঋণের সুদ। আবার এ সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে ঋণ নিয়ে। আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় বেশির ভাগ অর্থাৎ ৮০ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে সুদ পরিশোধে, যা আগের বছরের বাজেটে ছিল ৬৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এ সুদ ব্যয় অনুন্নয়ন বাজেটের একক খাত হিসাবে সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরেও একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ছিল ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। এ হিসেবে এক বছরে ঋণ পরিচর্চা বাবদ সুদব্যয় বাড়ছে ১১ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ১৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর গত ৬ বছরের ব্যবধানে সুদব্যয় বেড়েছে ১৪৩ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সরকারের রাজস্ব ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু যে হারে ব্যয় বাড়ছে সেই হারে আয় বাড়ছে না। এতে বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। আর বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতাও বাড়ছে। উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার পাশাপাশি ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে সুদব্যয়। এটা অব্যাহত থাকলে সামনে সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা ও সুদ পরিশোধেই বাজেটের সমুদয় অর্থ ব্যয় করতে হবে। সঙ্কোচিত হয়ে যাবে উন্নয়ন বাজেট।

আগামী অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার সামগ্রিক বাজেটের মধ্যে অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ১৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এ অনুন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে শুধু ঋণের সুদেই ব্যয় হবে ৮০ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। আর সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা মিলে পরিশোধ করতে হবে ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ছিল ৬৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও ঋণের সুদ মিলে ব্যয় হবে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা জানান, প্রতি বছরই সরকার বাজেটের আকার বাড়াচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী আয় বাড়াতে পারছে না। এ কারণে ঋণ নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে বাজেট বাস্তবায়নে। ঋণ নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে সুদব্যয়। যেমন, গত ৬ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদব্যয় বেড়েছে শতভাগের বেশি। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটে সুদব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ৬ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে হয়েছে ৮০ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা জানান, চলতি অর্থবছরে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতি থাকবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায়ে বিশাল অঙ্কের অর্থাৎ ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতি বাজেট দেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতি বাজেটের পুরোটাই ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে। এ ঋণের মধ্যে ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে নেয়া হচ্ছে ৮৭ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে ৪০ হাজার ১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আর ঘাটতি বাজেট অর্থায়নে বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নেয়া হবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।

এদিকে প্রতিবছরই ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সুদব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ ব্যয় ধারা হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদই পরিশোধ করতে হবে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে ৬ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। মোট ৭১ হাজার ২৪৪ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ করতে হবে, যা প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি।

এবার করোনার ক্ষত কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে যে ক্ষত দেখা দিয়েছে তা সারতে দীর্ঘ দিন লেগে যেতে পারে। ফলে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরের বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও কঠিন হতে পারে। এটা হলে সরকারের ব্যয় ঠিক রাখতে আগামী অর্থবছর শেষে ব্যাংক ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ছেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে সুদব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এটা কমাতে না পারলে সুদব্যয় পরিশোধেই বাজেটের বেশির ভাগ ব্যয় হয়ে যাবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/669364