১০ জুন ২০২২, শুক্রবার, ১২:৪৮

কতটা স্বস্তি ফিরবে বাজারে!

দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট পেশ করলেও প্রশ্ন হলো সাধারণ জনগণ কি পেল। নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না। বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে কি না। ব্যাগ ভরে বাজার করে বাসায় ফিরতে পারবে কি না। ঋণের জাল থেকে মানুষ মুক্ত হতে পারবে কি না। কর্মস্থান বাড়বে কি না। এসব প্রশ্নের উত্তর প্রস্তাবিত বাজেটে আসলে কতটা আছে তা দেখার বিষয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রস্তাবিত বাজেট ছয় লাখ ৭৮হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের চেয়ে ৭৪ হাজার তিন কোটি টাকা বেশি। বাজেটের আকার বাড়লেও বাজারে কোন স্বস্তি নেই। এতে করে সাধারন মানুষ বলেছে এতে আমাদের কোন কিছুই পাওয়ার নেই। এতে বাজারের আগুন নিভবে না। দেশের দৃম্য মান উন্নতি হলেও সাধারন মানুষ কোন স্বস্তি পাচ্ছে না। গত কয়েক বছর ধারেই দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রন করতে পারেনি। বাজারে কোন স্বস্তি নেই। মানুষ নানাভাবে ক্রয় ক্ষমতা হারাচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়ছে না। তার সাথে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারি। ইউক্রেন যুদ্ধ ও দেশে দুর্নীতি- এই তিনটি বিষয় সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চেপে ধরেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জিডিপির ভালো প্রবৃদ্ধি সাধারণ নাগরিকদের স্বস্তি দিচ্ছে না। কিন্তু কেন?

মানিক নগরের বাসিন্দা এডভোকেট শাহ আলম সরকার বলেন, ৬লাখ কোটি টাকার বাজেট করলেও জনগনের কোন লাভ নেই। দ্রব্যমূল্যের নামে জনগনের পকেট কাটা হচ্ছে। মানুষের মাধে কোন স্বন্তি নেই। এওই বাজেটে যদি নিত্য পণ্যের দাম কিছুটাও কমে তাহলে আমি মনে করি জনগনের উপকার হবে। কিন্তু আসলে তা হবে না। বিলাস পন্যের দাম বাড়ছে সাথে সাথে নিত্য পণ্যে দামও বাড়বে।

সরকার বলছে মানুষের মাথা পিছু আয় বাড়ছে জিডিপির প্রবৃদ্ধিথ বাড়ছে। কিন্তু পরিসংখ্যান ব্যাুরো এ রিপোর্ট নিয়ে দাতা সংস্থাগুলো বরাবরই প্রশ্ন তুলে আসছে। একইভাবে সিপিডিসহ বেশ কয়েকটি সংস্থাও প্রশ্ন তুলছে। একই সাথে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়েও। তাদের এই প্রশ্নের হালে বাতাস লেগেছে। বাজারে আগুন জ¦লছে। মানুষের পকেটে টাকা নেই। বেকারত্ব বাড়ছে বিনিয়োগ কমছে। ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণ বাড়ছে। আর এসব কারণেই সরকারের এই সব সুচক মানতে নারাজ।

দ্রব্য মূল্যের এই বাজারে মানুষ এমনিতেই দিশেহারা। তার মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাশিযা ইউক্রেন যুদ্ধ। যঙা গোটা বিশ^কে কাপিয়ে তুলছে। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে,উন্নয় না খাবার চাই।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটকে এক বছরের সাধারণ আয়-ব্যয়ের হিসাব হিসেবে দেখলে চলবে না। বাজেট বাস্তবায়ন নীতি স্পষ্ট থাকা দরকার, আর দরকার দুর্নীতি প্রতিরোধ, অর্থপাচার রোধ এবং প্রবৃদ্ধির সুফল যেন সবাই পায় তার জন্য নীতি নির্ধারণ।

প্রস্তবিত বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি ধরেছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু গত মাসেও মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল। আসলে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। সানেম নিজস্ব গবেষণার ভিত্তিতে সানেম বলছে,শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো গড়ে তাদের মোট খরচের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে। আর গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বিবিএস এ ক্ষেত্রে যে হিসাব দেয়, তার তুলনায় এ হার অনেক বেশি। বিবিএসের হিসাবে শহর ও গ্রামের পরিবার তাদের মোট খরচের যথাক্রমে ৪৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ৫৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে।

সানেমের প্রাক্কলনে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শহর ও গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক গোষ্ঠীর গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে শহর ও গ্রামীণ এলাকার জন্য এ হার ছিল যথাক্রমে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ ও ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। আর কারণেই এই বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রনে রাখা।

সরকার যদি বাজারে দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারে তাহলেই এই বাজেট জনগনের কাছে আসতে পারে। তা না হলে সরকার বাজেট যত লাখ কোটি টাকাই করুক না কেন তাতে জনগনের কিছু আসে যায় না।

সরকার নিজে মেযন ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে তেমনি সাধারণ জনগণও ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে। এতে করে মানুষের হতে হতাশা বাড়ছে। বাড়ছে অতœহত্যার প্রবণতাও। এ থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সরকার ২লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রেখে এবারের বাজেট ঘোষনা করা হয়েছে। যার মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশ থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। দেশের অভ্যান্তরিত খাত থেকে ঋণ নিলে বিনিয়োগে বাধাগ্রস্ত হয়। আর বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলো কর্মসংস্থান কম হয়। আর কর্মসংস্থান কমলে বেকারত্ব বাড়ে। এভাবে বেকারত্ব বাড়লে দেশে আইনশৃংখলার অবনতি হবে। এতে করে দেশে নানাভাবে অস্বস্তি তৈরি হতে থাকে।

ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকনোমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, প্রবৃদ্ধি হলে, মানুষের আয় বাড়লে ট্যাক্স আদায়ও তো বাড়বে। সেটা তো বাড়ছে না। তাহলে যাদের আয় সত্যিকার অর্থেই বাড়ছে তারা কি ট্যাক্স দিচ্ছেন? তারা যদি ট্যাক্স দিতেন তাহলে সাধারণ মানুষের জন্য সরকার তা কাজে লাগাতে পারত।

তার কথা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এটা বৈশ্বিক প্রভাব ছাড়াও অভ্যন্তরীণ মনিটরিং ব্যবস্থার অভাবের কারণে প্রকট হয়েছে। আর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গরিব মানুষের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা কি তারা ঠিকমত পাচ্ছেন?

এবারের বাজেটে রাজস্ব আয় চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ধরা হতে পারে। ঘাটতির পরিমাণ হতে পারে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। বাজেটে ভর্তুকি এবং প্রণোদনা বেড়েছে। এই দুই খাতে বরাদ্দ থাকতে পারে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের চেয়ে ২৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা বেশি।

ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, সাধারণ মানুষ এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যে চরম সংকটে আছে তা থেকে তাদের মুক্তি দিতে না পারলে আরো সংকট তৈরি হবে। তাই বাজার মনিটরিং-এ সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারকে টিসিবির কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে তেলসহ আরো অনেক ভোগ্যপণ্য আমদানি করা যেতে পারে। বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। আর সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তায় আরো বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না, এটা যারা প্রাপ্য তারা যেন পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

তার কথা, ইনফ্লেশন কমানো একটা কৌশলগত ব্যাপার। এটা কমালে আবার সুদের হার বাড়বে। তখন উৎপাদন ও কর্মস্থানে প্রভাব পড়ে। এই দুইটির একটা ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। আমদানি ব্যয় কমাতে হবে। আর স্বল্প মেয়াদে হলেও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, করোনার সময় রিজার্ভ বেড়েছিল। কিন্তু এখন রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। কোভিডের সময় রেমিটেন্স ভালোই এসেছে। আবার আমদানি কম হয়েছে। কিন্তু এখন তো আমদানি বেড়ে গেছে। আমরা তখনই বলেছিলাম যে এই অবস্থা থাকবে না। এখন কোভিড রিকভারির সময়। তাই চাপ পড়ছে। বাজেটে এই চাপ থেকে বের হওয়ার একটা কৌশল থাকতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ, সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ঘাটতি বাজেটে অর্থের সংস্থানই এবারের বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন। তিনি আরো যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বলেন তার মধ্যে রয়েছে বাস্তবায়ন,বিনিয়োগ,কর্মসংস্থান এবং দুনীর্তি নিয়ন্ত্রনর করা।

ড. মোয়াজ্জেম বলেন, বেসরকারি খাতে এখন যা অবস্থা তাতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। আর সেটা যদি হয় তাহলে কর্মসংস্থানের সংকট তৈরি হবে। করোনায় অনেকে কাজ হারিয়েছেন, অনেকের আয় কমে গেছে তাই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, সরকার নিজেই এখন খরচ কমানোর কথা বলছে। এটা করতে হলে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কম গুরুত্বপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। গত বাজেটে দেখেছি ৩২টি প্রকল্প আছে যার প্রতিটির জন্য বরাদ্দ মাত্র এক লাখ টাকা করে। এই ধরনের প্রকল্প নেয়াই হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো প্রকল্প নেয়া যাবে না।

সরকারের পরিচালন ব্যয়ে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে হবে। অর্থপাচার বন্ধ করতে পারলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। সামনে নির্বাচন। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক প্রকল্প নেয়া হয়। এখন দেখা যাক সরকার সেটাকে কীভাবে লাগাম টেনে ধরে, বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

আর বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় এখন দুর্নীতি বন্ধ ও রাজস্ব আদায়ে জিরো টলারেন্সে যেতে হবে। শুধু টার্গেট দিয়ে লাভ হবে না। কিন্তু এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারকরা পলিসি নির্ধারণে কতটা আন্তরিক হবেন তা নিয়ে ড. নাজনীন আহমেদ সন্দেহ পোষণ করেছেন। এই দুই অর্থনীতিবিদের মতে, অর্থনীতির এখন নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। তাই পরিকল্পনা অনেক সুচিন্তিত হওয়া প্রয়োজন। মাথায় থাকতে হবে সাধারণ মানুষের স্বস্তি। তাদের জীবনযাত্রার খরচ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। কারণ সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি। তাদের যদি স্বস্তি দেয়া যায় তাহলেই বাজেট সফল হবে বলে মনে করেন তারা।

https://dailysangram.info/post/491844