১০ জুন ২০২২, শুক্রবার, ১২:৪৭

সরকারের ঋণ নির্ভরতার বাজেট ॥ বাধাগ্রস্ত হবে বেসরকারি বিনিয়োগ

দেশের ইতিহাসে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার রেকর্ড ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত এ বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস হতে এ ঘাটতি মেটানো পরিকল্পনা সরকারের। সে লক্ষ্যে সরকার বাজেটে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকারও বেশি নির্ধারণ করেছে। নতুন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঋণ নেয়ার পরিমাণও বাড়িয়েছে সরকার।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকার বেশি ঋণ নিয়ে গেলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের শিল্প বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। প্রস্তাবিত এ বাজেটের এ ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে এক লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা, যার মধ্য থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে। ফলে প্রকৃত বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যে ঋণ নেয়া হবে তার মধ্যে এক লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা নেয়া হবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। এর মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ ৬৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আর স্বল্প মেয়াদি ঋণ ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক বহির্ভূত ঋণ ধরা হচ্ছে ৪০ হাজার ১ কোটি টাকা। যার মধ্যে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং ৫ হাজার ১ কোটি টাকা অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে।

নতুন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি অন্যান্য খাত থেকে ঋণ নেবে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা। সবমিলে সরকার ব্যাংক বহির্ভূত ঋণ নেবে ৪০ হাজার ১ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশই নেয়া হবে ব্যাংক থেকে, যার পরিমাণ ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্য থাকলেও তা অনেক ছাড়িয়ে যাবে বলে সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়।

বাজেটে বিশাল ঘাটতি পূরণে সরকার কোন খাত থেকে কত টাকা ঋণ নেবে তারও একটি ছক তৈরি করেছে। ছক অনুযায়ী, এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেবে এক লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ হিসেবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা ধার নেয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা আছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে সরকার সবচেয়ে বেশি ধার নিতে চায় ব্যাংক খাত থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে। এই অংক চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আছে।

অর্থনীতিবীদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ, সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঋণ। এর সুদের হার সব ঋণের চেয়ে বেশি। এছাড়াও ব্যাংক ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সেটি পুরোপুরি নেয়া হলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমবে। সেটি হলে বেসরকারি বিনিয়োগ ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ বিষয়ে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণের প্রয়োজন আছে। তবে ঋণ গ্রহণের সময় কম সুদে যেখানে পাওয়া যায় সেটি দেখতে হবে। পাশাপাশি কোন প্রকল্পের জন্য, কেন ঋণ নিচ্ছি এগুলো এখন বুঝতে হবে। যেন সমস্যায় পড়তে না হয়।

এদিকে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা আগামী বছরে বাড়ছে শুধু তাই নয়, চলতি অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার বেশি ঋণ নিতে যাচ্ছে সরকার। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের শেষ দিকে এসে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা বেশি নেয়া হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন। কিন্তু সরকার নিজেই ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ গ্রহণ করলে নির্ঘাত বেসরকারি খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। বিনিয়োগের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা নিয়েও সংশয় থাকবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রীলংকার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে বড় অংকের বিদেশী ঋণ গ্রহণ। আমাদের বিদেশী ঋণ নিতে সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ভর্তুকির পরিমাণও বাড়ছে। প্রাথমিক প্রাক্কলনে এবারে এই খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে গত ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে এবারের প্রাথমিক প্রাক্কলনে ভর্তুকি ব্যয় বাড়ছে ১৫ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী বলেন, সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সরকারের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার ওপরও চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের প্রাথমিক প্রাক্কলনে ব্যয় এবার আরও বেড়েছে জিডিপির ১ দশমিক ৯০ শতাংশ। এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে উল্লেখ করেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যের সাম্প্রতিক যে গতিপ্রকৃতি তাতে ভর্তুকি ব্যয় আরও ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা আগামী অর্থবছরের বাজেট ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

https://dailysangram.info/post/491832