১০ জুন ২০২২, শুক্রবার, ১২:৪৪

কেন শুধু ডলারেরই দাম বাড়ছে

-ড. মো: মিজানুর রহমান

বিশ্বের সব দেশেরই একটি নিজস্ব মুদ্রা রয়েছে। আবার ইউরোপীয় দেশগুলোর সমন্বয়ে গড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের রয়েছে একটি কমন মুদ্রা, যা ইউরো নামে পরিচিত। বৃহৎ অর্থনীতির দেশের মুদ্রাগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড, ইউরোপের ইউরো, কানাডার ডলার, সৌদি রিয়াল, কুয়েতি দিনার, জাপানি ইয়েন, চীনের ইউয়ান প্রভৃতি বহুল ব্যবহৃত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মুদ্রা। অথচ বর্তমান বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় শুধু ডলারের দাম বাড়ছে; অন্য কোনো দেশের মুদ্রার দাম বাড়ছে না, বরং কমছে বা কমানো হচ্ছে। কেন শুধু ডলারের দাম বাড়ছে এবং অন্য মুদ্রার দাম কমছে, সেই বিষয়ে আজকের এই লেখা।

ডলারের দাম অন্য মুদ্রার চেয়ে কেন বাড়ছে; সে কথা বলার আগে অন্য মুদ্রার দাম যে কমছে তার কিছু তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। দ্য ইউএস ডলার ইনডেক্স অনুযায়ী, ডলারের বিপরীতে জাপানি ইয়েনের মান কমেছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, ব্রিটিশ পাউন্ড ও ইউরোর দাম কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে, সুইস ফ্রাঁর মান কমেছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ আর চীনের মুদ্রা ইউয়ানের মান কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ।

প্রশ্ন হলো- অন্যান্য মুদ্রার মান কমলেও ডলারের দাম কেন কমছে না বরং বাড়ছে? এর জবাব জানতে হলে ডলারের কিছুটা ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়োজন উপলব্ধি করছি। ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বে তখন অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছিল। এ সঙ্কট মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে বিশ্বের ১০টি শিল্পোন্নত দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা একটি বিশেষ বৈঠকে বসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর। মুদ্রার (ডলারের) বিষয়ে অবমূল্যায়ন না করার একটি নীতি চলে আসছিল অনেক দিন ধরে যাকে ব্রেটনউডস ব্যবস্থা বলা হতো। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন একতরফাভাবে ব্রেটনউডস ব্যবস্থা (ডলার অবমূল্যায়ন না করার নীতি) বাতিল করেন; এটি এখনো ‘নিক্সন শক’ বলে প্রচলিত। নিক্সন নিজেদের বাণিজ্য সক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই ডলারের অবমূল্যায়ন করেছিলেন। মূলত এই একতরফা অবমূল্যায়নের প্রতিবাদ করতেই ছিল ওই বৈঠক। অন্য অর্থমন্ত্রীরা যখন একতরফা অবমূল্যায়নের প্রতিবাদ করছিলেন, তখন নিক্সন প্রশাসনের ট্রেজারি সেক্রেটারি বলেছিলেন, ‘এটি আমাদের মুদ্রা, কিন্তু সমস্যাটা তোমাদের’। মূলত তখন থেকেই বাণিজ্যযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের নাম ‘ডলার’। সাথে যোগ হয় ডলারকে পেট্রলের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারা। অর্থাৎ ডলার ছাড়া পেট্রল ক্রয় করা যাবে না; ফলে বিশ্বের সব দেশকে ডলারের মাধ্যমে লেনদেন করতে হবে; এভাবে একটি দেশের মুদ্রা আন্তর্জাতিক মুদ্রায় পরিণত হয়। বিশ্ব বাণিজ্যে ডলারের একচেটিয়া আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্রকে এ সুযোগ করে দিয়েছে। আর সেই অস্ত্রই এখন আবার প্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র; তাতেই বিপদে পড়ছে বাকি বিশ্ব।

আসা যাক বিশ্ব বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র ডলার অস্ত্র এখন কিভাবে ব্যবহার করছে সে প্রসঙ্গে। করোনা অতিমারী চলছিল ২০২০ সালের শুরু থেকে। এতে সারা বিশ্বের অর্থনীতি বিপাকে পড়ে। প্রায় দুই বছর পর ২০২১ সালের শেষে করোনার প্রভাব কমে এলে শুরু হয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার। তবে এই দুই বছরব্যাপী করোনার প্রভাবে উৎপাদন যেমন কমে; পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থাও অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়, পণ্য পরিবহন খরচও বেড়ে যায়, ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল বিশ্বব্যাপী। এ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শেষ না হতেই রাশিয়া আক্রমণ করে বসে ইউক্রেনে। ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম যুদ্ধ দেখল ইউরোপ; মহাদেশটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ইউরোপে খনিজসম্পদ বলতে রাশিয়ার তেল-গ্যাস, যার ওপর নির্ভর করতে হয় মহাদেশের প্রায় সবগুলো দেশকে। তেমনি কোনো বিকল্প না রেখে রাশিয়ার তেল-গ্যাস বিশেষ করে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলো। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিপাকে পড়ে ইউরোপের দেশগুলো।
তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকার কথা ছিল চীনের। কিন্তু জিরো করোনা পলিসি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে লকডাউন পলিসি অনুসরণ করতে হচ্ছে চীনের অনেক শহরে, ফলে বাণিজ্যে পিছিয়ে যাচ্ছে দেশটি।

বড় অর্থনীতির মধ্যে বাকি থাকে যুক্তরাষ্ট্র; অন্য দেশগুলোর সমস্যার সুযোগ নিচ্ছে দেশটি। করোনার প্রভাব দ্রুতই কাটিয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ওয়াশিংটন দূর থেকে যুদ্ধ করাচ্ছে বলে নিজের অর্থনীতির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি; কেবল মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজের নাগরিকদের সন্তুষ্টির প্রতি সর্বদা সজাগ, ফলে তাদের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্যই থাকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। অথচ এবার সেই মূল্যস্ফীতি শতকরা ৮ ভাগ ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, যা ছিল গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশটি সুদের হার আধা শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। একবারে এত সুদের হার বাড়ানো ছিল গত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিশ্ব অর্থনীতিতে ইউরোপ এখন মন্দায়, চীন নিষ্ক্রিয়, রাশিয়া নিষেধাজ্ঞায়; একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি স্থিতিশীল। ফলে বিনিয়োগের একমাত্র মাধ্যম ডলার এবং বিনিয়োগ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। এতে দেশটিতে ডলার ঢুকছে এবং বিনিয়োগ বাড়ছে শেয়ার ও বন্ডে। মূল্যস্ফীতি ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি এই দু’টি যেন একই সূত্রে গাঁথা। ডলারের চাহিদা এখন বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পেছনে দু’টি কারণ। প্রথমটি- বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চিত একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি ও বড় বিনিয়োগে যেতে চাচ্ছেন না। আপদকালে তারা সোনা অব ইউএস ডলারে বিনিয়োগ করছেন। সোনার জোগান সীমিত, তাই ইউএস ডলারের দিকে ঝুঁকছেন। দ্বিতীয়টি- পণ্য আমদানিকারক দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, সেখানে অর্থায়নের দরকার পড়ছে। সেখানেও ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন ডলারের দাম ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেল ও বিভিন্ন ধাতব পণ্য বিক্রি হচ্ছে শুধু ডলারে। আমদানি মূল্যও কম পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের।

ডলার চাঙ্গা থাকায় যেসব দেশ জ্বালানি তেল, খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য এবং ধাতব পণ্য রফতানি করে সেসব দেশ অত্যন্ত ভালো অবস্থানে আছে। এসব দেশের আয় বাড়ছে। অন্য দিকে আমদানিনির্ভর দেশগুলোর সবাইর আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে দেশগুলো বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির সাথে মুদ্রাস্ফীতিও যেন আমদানি করছে। যুদ্ধের কারণে এক দিকে বিশ্ববাজারে প্রায় সব পণ্যের আমদানি মূল্য বেড়ে গেছে, অন্য দিকে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় অন্য দেশগুলো থেকে নিরাপদ বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে পুঁজি ঢুকছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ দুইয়ের প্রভাবে প্রায় সব দেশই নিজের মুদ্রাকে ডলারের বিপরীতে অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে।

সাধারণত যেসব দেশের আমদানি কম রফতানি বেশি, সেসব দেশই অবমূল্যায়নে বেশি আগ্রহী হয়। মূলত সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিলে একটি দেশ অবমূল্যায়ন করে থাকে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের সময় বাণিজ্যযুদ্ধে জয়ী হতে চীন মুদ্রার বড় আকারের অবমূল্যায়ন করেছিল। চীন তখন চেয়েছে রফতানি বাড়ুক। কারণ এতে রফতানিকারকরা উৎসাহিত হয়ে রফতানি বাড়িয়ে দেবে, তাতে রফতানি আয় বাড়বে, তখন লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি কমবে।

বাংলাদেশে এখন চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কেননা বাংলাদেশের বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। কারণ রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি, সাথে রেমিট্যান্স কম। এতে ডলারে টান পড়েছে, ফলে টাকার মান কমছে বা কমাতে হচ্ছে; ধারণা করা হচ্ছে, এতে রফতানিকারকরা উৎপাদন বাড়িয়ে দেবেন। অবশ্য বাংলাদেশের মতো দেশে উৎসাহ পেলেই উৎপাদন বাড়াবে, এমন নাও হতে পারে। এর জন্য অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতা থাকতে হবে, ভালো বিনিয়োগের পরিবেশ থাকতে হবে। ফলে টাকার অবমূল্যায়ন করে সামগ্রিক অর্থনীতির ঘাটতি মোকাবেলা বাংলাদেশের জন্য কঠিন হবে বরং আমদানি কমিয়ে এবং রেমিট্যান্স বাড়িয়ে ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করতে হবে। সর্বোপরি বলতে হয়, এ বছর ডলার চাঙ্গাই থাকবে যদি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে থাকে।

এ পরিস্থিতি সামাল দিতে ডলারের চাহিদা কমাতে হবে এবং জোগান বাড়াতে হবে। তবে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করে এটি হবে না। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ আমদানি এবং প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। শুধু রফতানিকারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে। ডলারের বাস্তব দরটা সরকারি দরের থেকে অনেক বেশি। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ তখনই সম্ভব যখন চাহিদা ও জোগানের ঘাটতি পূরণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করা সম্ভব, কিন্তু বাংলাদেশে সেটা কত দিন সম্ভব? যদি সঙ্কটটা সাময়িক হতো তা হলে সম্ভব হতো। রিজার্ভ এখন নিম্ন পর্যায়ে চলে আসছে। সে কারণে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে স্বাভাবিক দাম হতে দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, যদিও এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com;
mizan12bd@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/669295