১০ জুন ২০২২, শুক্রবার, ১২:৪১

আমও যাবে, ছালাও যাবে

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

কেউ যখন কাউকে এমন ভাষায় সতর্ক করে দেন যে, ঐ কাজটি করলে বা না করলে ‘আমও যাবে, ছালাও যাবে’, তখন এটা স্পষ্ট হুমকি। এটি একটি প্রবাদ বাক্য। যার মধ্যে হুমকি আছে। কারও যদি আম ছালা দুটিই যায়, তবে তার আর সর্বস্বান্ত হবার কিছু বাকি থাকে না।

‘এখন এমন দুর্দিনে পড়েছেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। বেশ কিছুদিন ধরে তারা মিরপুর এলাকায় দ্রব্যমূল্য হ্রাস ও বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছেন। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করে আজকে দেশে স্থিতিশীলতা আমরাই আনতে পেরেছি। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্ব মন্দাতে উন্নত দেশগুলোকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। ঐসব দেশে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। অনেক উন্নত দেশে খাদ্য সঙ্কটের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ইংল্যান্ডের মানুষকে সীমিত আকারে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। ভোজ্যতেল এক লিটারের বেশি কেউ নিতে পারবে না এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে। বাংলাদেশে ভর্তুকি দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশ এখনও সবার খাদ্য, ওষুধ, ভ্যাকসিন সবকিছুর সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পেরেছে।

তিনি বলেন, আমরা প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছি। রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে তুলেছিলাম, সেই টাকা ভেঙে ভেঙে বিদ্যুৎ, গ্যাস, কৃষি ও স্বাস্থ্যের জন্য ভর্তুকি ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। এভাবে কোনো দেশ করেনি। তিনি বিনামূল্যে করোনার টিকা ও করোনা পরীক্ষার কথা তুলে ধরেন। তারপরও কেউ যদি গোলমাল করার চেষ্টা করে, আর এই দেশটা যদি একেবারে স্থবির হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হবে।

গ্রামের মানুষের অবস্থান এখনও ভালো আছে। শেখ হাসিনা বলেন, সেটা যাতে ভালো থাকে, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছি। আমাদের মাটি আছে, মানুষ আছে, ফসল ফলাতে হবে। নিজেদের খাবারের ব্যবস্থাটা অন্তত আমরা নিজেরা করব। কারণ বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব, খাদ্যমন্দা সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার ও খাদ্য অপচয় না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই সঞ্চয় করুন। কেননা, সব কিছু তো আর সরকার করতে পারবে না, নিজেকেও করতে হবে। এটা আমি আমাদের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণকে বলব।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তাড়াতাড়ি থামবে না। যুদ্ধের কারণে আমদানি পণ্যের পরিবহন ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জিনিসপত্রের দামে এর প্রভাব পড়ছে।

তিনি বলেন, কয়েক দিন ধরে দেখতে পাচ্ছি, গার্মেন্ট শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। তৈরি পোশাক খাত অস্থির করতে যারা উসকানি দিচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। তিনি বলেন, আন্দোলন করে, ঠিক আছে। কিন্তু যেসব দেশ আমাদের তৈরি পোশাক কিনবে, তাদের কাছ থেকে আমরা ভালো সুবিধা পাচ্ছি, উৎপাদন বাড়ছে, এ সমস্ত শ্রমিকদের বেতন তো বন্ধ হয়নি।

আমরা তো নিজেরা প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছি। মালিকদের বলে কয়েক দফায় বেতন বাড়িয়ে দিয়েছি। এ সমস্ত শ্রমিকদের ভর্তুকি দিয়ে পোশাক কারখানার বেতনটা যাতে সরাসরি পায়, সেই ব্যবস্থাও করেছি। তিনি বলেন, ‘আজকে বেতন বাড়াও, এটা সেটাসহ নানান ধরনের আন্দোলন করতে যায়, পোশাক রফতানি যদি বন্ধ হয়, তাহলে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আমও যাবে, ছালাও যাবে।’ বেতন আর বাড়বে না, তখন চাকরিই চলে যাবে। তখন কি করবে? যে নেতারা উস্কানি দিচ্ছে, তারা কাদের প্ররোচনায় উস্কানি দিচ্ছে, সেটাও একটু ভেবে দেখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর কথার সারমর্ম যা বোঝা গেল, তা হলো গার্মেন্ট শ্রমিকদের কল্যাণে অনেক কিছু করা হয়েছে। যারা গার্মেন্ট পণ্য কেনে, তাদের ত্রাহি অবস্থা। তারা তিন বেলা ঠিক মতো খেতে পায় না। সেই তুলনায় আমরা অনেক ভাল আছি।

তাই যদি হয়, তাহলে আমরা নাকি খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ। ঐসব দুর্দশাগ্রস্ত দেশের জনগণের জন্য ১০-২০ হাজার টন খাদ্য পাঠিয়ে বন্ধুত্বের নিদর্শন দেখান। পোশাক রফতানি বন্ধ হলে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন বাংলাদেশী শ্রমিকদের আম ছালা দুটোই যাবে। অতএব ভুলেও আন্দোলন করতে যাবেন না। কিন্তু আন্দোলন না করলে দাবি আদায় হবে কি করে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চাকির থাকবে না। কিন্তু সরকারের তোষামদকারীরা তখন কী খাবেন।

এই গরীব গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপরই তাদের ভাগ্য ও বিলাসী জীবন নির্ভরশীল। ট্যাক্স আসবে কোথা থেকে। সরকারের বিলাসিতা চলবে কীভাবে। আর সরকারের খাঁইরা শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করবে কীভাবে। এখানে আম ছালার প্রশ্ন উঠছে না কেন।

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। তরিতরকারিও সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এর মধ্যে প্রতি সপ্তাহে বাড়ছে তেল-গ্যাস বিদ্যুতের দাম। শ্রমিক কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে। শ্রমিকের দাবি আদায়ের একমাত্র পথ তাই আন্দোলন। আন্দোলন করেই তাকে দাবি আদায় করতে হয়। সরকার ঘুষ হিসেবে সরকারি বেতন দ্বিগুণ করে দিয়েছেন। ফলে বাজার আরও চড়েছে। শ্রমিক মোটাতাজা হননি। সুতরাং তাদের কাছে আম-ছালার গল্প হাস্যকর। তাদের ব্যাগ ভরে আম দেন, ছালা টান দেবেন না। এদেশে বালক-বালিকারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করে সফল হয়েছিলেন। শ্রমিকরা তা পারবেন না কেন?

সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ৫০ জন লোক নিহত হয়েছে। সেই রাসায়নিক ডিপোর মালিককে এখনও খুঁজে বের করতে পারেনি সরকার। কারণ ঐ মালিক মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। তবে সবকিছু থিতু হয়ে গেলে তাকে হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এখন ভয়াবহ অমানবিক পরিস্থিতি। সেখানে শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী নওফেলের লোকেরা নার্সদের মারধোর করায় তারা কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এখানে আম-ছালা কার যাবে। যে নার্সরা দিন রাত পরিশ্রম করে আহতদের সেবা করেছেন, আম-ছালা অর্থাৎ চাকরি-বেতন কি তাদের যাবে।

নাকি নওফেলের যে পারা নার্সদের ওপর হামলা চালিয়েছে তাদের যাবে। কেউ কি স্পষ্ট করে সে কথা আমাদের বলতে পারেন? নার্সরা যদি চুপ করে থাকেন, তাহলে ন্যায়বিচার পাবেন না। ন্যায়বিচারের জন্য তাদেরও সম্ভবত আন্দোলনের পথেই যেতে হবে।

https://dailysangram.info/post/491803