৯ জুন ২০২২, বৃহস্পতিবার, ১২:৩৯

আমদানিতে নিরাপত্তা নিয়ে কড়াকড়ি, রপ্তানিতে নেই

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণে বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। এসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচটি ধাপ মেনে নিরাপত্তার শর্ত নিশ্চিত করে জাহাজ থেকে নামিয়ে বন্দরে আনা হয়। কিন্তু একই ধরনের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এমন কোনো শর্ত বা বিধি নেই।

শুধু বন্দরের ক্ষেত্রে নয়, সড়কপথেও এসব পণ্য অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে পরিবহন করা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। গত শনিবার সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনে রাসায়নিক কনটেইনার থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর এই নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেছে।

রপ্তানিনীতিতে রাসায়নিক পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো শর্ত নেই বলে নিশ্চিত করেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রপ্তানিতে নিরাপত্তা নিশ্চিতের কোনো শর্ত আমাদের নেই। এমনকি কোনো এসিড রপ্তানিতেও শর্ত নেই। তবে আমদানির ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন শর্তযুক্ত করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। ’

আমদানি নিরাপত্তা মেনে

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিপজ্জনক রাসায়নিক পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে জাহাজ থেকে বন্দরে আনা পর্যন্ত সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পণ্য ছাড় করতে অন্তত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নিতে হয়। আর এই কঠোরতা মানতে গিয়ে বন্দর-কাস্টমের সমন্বয়হীনতার কারণে সময় ও আর্থিক মাসুলও গুনতে হয় আমদানিকারককে। এসব শর্ত শিথিল করতে অনেক সময় শিপিং এজেন্ট, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট দাবি করলেও নিরাপত্তার স্বার্থে তা মানা হয়নি।

রাসায়নিক পণ্য জাহাজ থেকে নামানোর আগেই এই ধরনের পণ্য ছাড়ের জন্য অনলাইনে আবেদন করে আমদানিকারকের নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। সঙ্গে চালানের বিপরীতে ইমপোর্ট জেনারেল মেনিফেস্ট (আইজিএম) জমা দেয়। আবেদন অনলাইনে দেখে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি টিম। আমদানির সপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজ জমার জন্য অবজারভেশন দেয় ওই টিম। সব কাগজপত্র পেলে প্রথম অনুমোদন দেয় নৌবাহিনী। এরপর কী পণ্য আনা হয়েছে তার জন্য নমুনা পরীক্ষা করে কাস্টম। সেখানে অনুমোদন পেলে রাজস্ব পরিশোধ ও ইনভেন্ট্রি (বর্ণনামূলক তালিকা) শেষে ছাড়পত্র দেয় কাস্টম।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই ধরনের পণ্য আমদানিতে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এই কড়াকড়ির কারণে কাগজপত্র জোগাড় করতে আমাদের অনেক সময় সময়ক্ষেপণ হয়, বাড়তি মাসুলও গুনতে হয়। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সেটা মেনে নিয়েছি। ’

তবে এত কড়াকড়ির পরও অনেক সময় বিপজ্জনক রাসায়নিক চট্টগ্রাম বন্দরে নামানোর পর পড়ে থাকে। নিলামে তুললেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেগুলো বিক্রি করা যায় না। বন্দর সূত্র জানায়, লেবাননের রাজধানী বৈরুতে সমুদ্রবন্দরে রাসায়নিক বিস্ফোরণের পর ২০২০ সালের আগস্টে প্রথমবারের মতো বন্দরে পড়ে থাকা এই ধরনের বিপজ্জনক রাসায়নিক ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয় কাস্টম। পরে দুই দফায় অন্তত ৫৯ টন বিপজ্জনক রাসায়নিক বিশেষ নিরাপত্তায় ধ্বংস করে চট্টগ্রাম কাস্টমস।

রপ্তানিতে নিরাপত্তা নীতিমালা নেই

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কাস্টমস কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, রাসায়নিক পণ্য রপ্তানিতে আমরা বিল অব লেডিং (বিস্তারিত তালিকা) দেখি। সেখানে পণ্যের ঘোষণা, মূল্য, বিদেশি ক্রেতার ডকুমেন্ট, ব্যাংকের ঋণপত্র দেখা হয়। এর বাইরে কী দেখতে হবে এমন কোনো নির্দেশনা নেই আমাদের কাছে। ফলে সেগুলো দেখারও প্রয়োজন হয় না। ’ রপ্তানির ক্ষেত্রে বিপজ্জনক রাসায়নিকগুলো অন্যান্য পণ্যের মতোই সাধারণভাবে বন্দর হয়ে জাহাজে তোলা হয়।

রপ্তানিতে নিরাপত্তা নিশ্চিতের কোনো শর্ত নেই উল্লেখ করে ইপিবির মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএম কনটেইনার ডিপোতে যে বিস্ফোরণ হয়েছে সেটি রাসায়নিকের কারণে হয়নি। রাসায়নিক যথাযথভাবে না রাখার কারণে হতে পারে। এ জন্য গুদামে এই পণ্য রাখার অনুমোদন ছিল কি না বিস্ফোরক দপ্তর বলতে পারবে।

জানতে চাইলে বিস্ফোরক দপ্তরের চট্টগ্রাম প্রধান মো. তোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ডিপোর গুদামে রাখার জন্য আমাদের অনুমোদন নিতে হয় না। কারণ ওই পণ্য আমাদের বিধিমালায় যুক্ত নেই। ’

সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্দরে এমন পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় বলে জানালেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে যদি কোনো রপ্তানিকারণ বিপজ্জনক পণ্যের ঘোষণা দেন, তাহলে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করে থাকে। বন্দরে প্রবেশের পর সেটা জাহাজে তোলা পর্যন্ত সেই নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। ’

বন্দর সূত্র জানায়, এসব পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো কার্গো বন্দরে রাখা হয় না। বন্দরে প্রবেশ করার পর সরাসরি এগুলো জাহাজে তুলে দেওয়া হয়।

সড়কপথে পরিবহনে ঝুঁকি

চট্টগ্রাম বন্দরে দিয়ে বছরে যে পরিমাণ বিপজ্জনক রাসায়নিক আমদানি-রপ্তানি হয় তার সবই সড়কপথে পরিবহন হয়। আমদানি পণ্য জাহাজ থেকে নামিয়ে কনটেইনারভর্তি লরিতে করে সড়কপথে কারখানার গুদামে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে রপ্তানি পণ্যও কাভার্ড ভ্যানে ভর্তি করে কারখানা থেকে সড়কপথে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রথমে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে আসে। এরপর চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে জাহাজে তুলে দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম বিস্ফোরক দপ্তর সূত্র জানায়, শুধু অতি ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক বা উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক পণ্যের পরিবহনেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। সাধারণভাবে রাসায়নিক সড়কপথে পরিবহনের সময় নিরাপত্তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মানা হয় না।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2022/06/09/1153806