৮ জুন ২০২২, বুধবার, ১১:৪২

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড কারখানা

পরিবেশ সনদ নেই চার মাস, বর্জ্য যায় হালদায়

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ভর্তি কনটেইনার বিস্ফোরিত হয়েছে, সেই রাসায়নিক উৎপাদন করা হচ্ছে হাটহাজারী উপজেলার সীমান্তে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের পাহাড়ঘেরা ঠাণ্ডাছড়ি এলাকায় আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সে। বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) না করায় পরিবেশ অধিদপ্তর গত ফেব্রুয়ারির পর আর কারখানাটির পরিবেশ সনদ নবায়ন করেনি।

কারখানাটি বিএম কনটেইনার ডিপোর মূল কম্পানি স্মার্ট গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। আল রাজি কেমিক্যালের বিরুদ্ধে টিলা ও পাহাড় কেটে কারখানা স্থাপনের অভিযোগ করেছে স্থানীয় ভূমি অফিস।

২০১৯ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার দায়ে তাদের ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল। এই কারখানার বর্জ্য প্রাকৃতিক নালা দিয়ে হালদা নদীতে গিয়ে মিশছে বলেও একাধিকবার অভিযোগ করা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরে।

হালদা বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে সরাসরি রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৪টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে। সম্প্রতি উদ্ধার করা হয়েছে দুটি বড় আকারের ডিমওয়ালা মাছ।

সোমবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কারখানার চারদিকে পাহাড়-টিলাঘেরা সমতল জায়গায় কারখানাটির অবস্থান। সেখান থেকে পৌনে এক কিলোমিটার দূরত্বে চট্টগ্রাম সেনানিবাস। দেড় কিলোমিটার দূরত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল। কারখানার পাঁচ বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই দক্ষিণ পাহাড়তলীসহ আশপাশের এলাকার দুই লক্ষাধিক মানুষের বসতি।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে স্থানীয় লোকজন গত সোমবার আল রাজি কারখানার সামনে বিক্ষোভ করেছে। ওই বিক্ষোভে যোগ দেন বর্তমান ও সাবেক কাউন্সিলর। দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. জাফর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লোকালয় ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পাশে গড়ে ওঠা এই কারখানা নিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। ’ সোমবারের বিক্ষোভে ছিলেন ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর শফিউল আজম। তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের মুখে কারখানা কর্তৃপক্ষ সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণের প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত কারখানায় রাসায়নিক উৎপাদন ও পরিবহন বন্ধ করতে রাজি হয়েছে। ’

রাসায়নিক কারখানার ঝুঁকি বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল মতিন কালের কণ্ঠকে বলেন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজ থেকে অগ্নিকাণ্ড সৃষ্টি করে না, তবে আগুনের সংস্পর্শে এলে বা উত্তাপ লাগলে আগুনের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। কারখানায় সংরক্ষণবিধি মানা হলে সমস্যা নেই, কিন্তু অমান্য করা হলে বা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটলে কী ঘটতে পারে, সেটা সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণ থেকেই বোঝা যায়। ’

আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর ভাই স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান।

নেই ইটিপি, নেই অনুমোদন

২০১৯ সালে আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা শুরু হয়। গত বছর উৎপাদনে যায় প্রতিষ্ঠানটি। এই কারখানায় পিভিসি পাইপ, প্লাস্টিকের দরজা ও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদিত হয়।

কারখানাটি ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন পায়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি এই অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) স্থাপন না করায় সেই অনুমোদন আর নবায়ন করেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।

বর্জ্য যায় হালদায়

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাসায়নিক কারখানার সামনেই ঠাণ্ডাছড়ি লেক। আর পেছনের অংশে কারখানার সঙ্গে লাগোয়া একটি পাহাড়ি ছড়ায় ফেলা হচ্ছে রাসায়নিক বর্জ্য। সেই বর্জ্য খাগরিয়া ও চিকনকণ্ডী এলাকার ছড়া পেরিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে হালদা নদীতে গিয়ে পড়ছে।

হালদা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরীয়া। তিনি বলেন, ‘আল রাজি কারখানার রাসায়নিক বর্জ্যে হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। এটা আমি পরিবেশ অধিদপ্তরকে একাধিকবার জানিয়েছি। ’ তিনি আরো বলেন, বর্ষাকালে সবচেয়ে বেশি বর্জ্য ফেলা হয় ছড়ায়, যা গড়িয়ে চলে যায় হালদায়। ফলে নদীর ডলফিন ও মাছ মারা যাচ্ছে।

পানিসম্পদ ও জলবায়ুু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, রাসায়নিক কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে গেলে নদীর জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি হয়। এসব নদীর পানি ব্যবহার করলে চর্মরোগ হবে। মানুষের পেটে গেলে পীড়া দেখা দেবে।

পাহাড়-টিলা কেটে স্থাপনা

স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমানের নামে এ পর্যন্ত এই কারখানার জন্য প্রায় ৯ একর জমির বিএস খতিয়ান করা হয়েছে। এসব খতিয়ানের মধ্যে পাহাড় ১.৩৬ একর এবং টিলা ০.৩২ একর। বাকি জমি ‘নাল’ শ্রেণির। ভূমি অফিসের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৯ একরের মধ্যে বেশির ভাগই পাহাড় ও টিলা। কিন্তু খতিয়ানে এগুলোকেও ‘নাল দেখানো’ হয়েছে।

২০২০ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য আবেদন করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। আবেদনটি যাচাই-বাছাই পর্যায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সরেজমিনে যান এবং পাহাড় ও টিলা কাটার প্রমাণ পান। এরপর আবেদনটি মঞ্জুর করা হবে না মর্মে জানিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য পরে অনুমোদন দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, পাহাড়-টিলায় রাসায়নিক কারখানা স্থাপনের অনুমোদন সাধারণত দেওয়া হয় না, কিন্তু চাপে পড়ে আইনের ফাঁক খুঁজে অনুমোদন দিতে হয়েছে। ইটিপি স্থাপনসহ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিল। সেই শর্তও মানেনি তারা।

এই কর্মকর্তার তথ্যের সূত্র ধরে কথা হয় পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অনুমোদনের সময় আমি ছিলাম না। তখন কী হয়েছিল তা জানি না। তবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরপর কারখানা কর্তৃপক্ষ নবায়নের জন্য আবেদন করে। কিন্তু ইটিপি প্ল্যান্ট না করায় অনুমোদন নবায়ন করা হয়নি। আগে শর্ত পূরণ করতে হবে। ’

পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমোদন দিলেও কারখানা চালানো বেআইনি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সরকারি কৌঁসুলি ফখরুদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘খতিয়ানে পাহাড়-টিলা শ্রেণির কথা উল্লেখ থাকলে সেখানে রাসায়নিক কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া যাবে না। যদি পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমতি দেয়, তাহলে অন্যায় করেছে। এখন পরিবেশ অধিদপ্তরেরই উচিত এই অনুমোদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখ্যা তলবসহ বিধিমতো ব্যবস্থা নেওয়া। ’

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মফিদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, আইনে আছে পাহাড়-টিলা কাটা যাবে না, শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এখন যদি ওই কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পাহাড়-টিলা কাটার বিষয়টি প্রমাণিত হয়, তাহলে সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

অতিরিক্ত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদন

পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতির শর্তে বলা ছিল, আল রাজি কারখানায় বছরে এক হাজার টন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদন করা যাবে। সেই হিসাবে দুই বছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার টন উৎপাদনের কথা।

কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল মোমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, কারখানার দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ১১০ টন। উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড দেশের বাজারে বিক্রি করা হয়। রপ্তানিও করা হয়। তবে বছরে কী পরিমাণ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড উৎপাদন করা হয়, তা তিনি বলতে রাজি হননি।

ওই কারখানায় উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিদেশে নিয়মিত রপ্তানি করা হয় উল্লেখ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রায় আট হাজার ৬৬২ টন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রপ্তানি করেছে আল রাজি কেমিক্যাল।

গত সোমবার কারখানার ফটকে এসে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল মোমিন। তিনি ভেতরে ঢুকতে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। বন্ধ পাওয়া যায় স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমানের ফোনও।

স্মার্ট গ্রুপের জিএম মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের বিষয়ে বিস্তারিত জানি না। বিষয়টি জেনে জানাচ্ছি। ’ আধাঘণ্টা পর আবার তাঁকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এখনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। সংগ্রহ করে জানাব। ’ তবে আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা সাদ আল মামুন দাবি করেন, ‘কারখানার অনুমোদনসংক্রান্ত সব কাগজপত্র ঠিক আছে। পাহাড়-টিলা কাটা হয়নি এবং কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে কারখানাটি যুক্ত নয়। ’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2022/06/08/1153500