৮ জুন ২০২২, বুধবার, ১১:২৭

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি

ধ্বংসের চিহ্ন রেখে নিয়ন্ত্রণে আগুন

আরও দুই লাশ উদ্ধার, মৃতের সংখ্যা ৪৩ হস্তান্তর ২৬

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়িতে বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন তিন দিন পর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮ ব্রিগেডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আরিফুল ইসলাম আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানান।

তিনি বলেন, নতুন করে এখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আর কোনো আশঙ্কা নেই। এই মুহূর্তে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ডিপোটি এখন বিপদমুক্ত বলেও জানান তিনি। ঘটনার তিনদিন পরও কোনো মামলা হয়নি। এদিকে দগ্ধ ও আহতরা যতদিন চিকিৎসা নিবেন তার ব্যয় সরকার বহন করবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমান।

শনিবার রাতে আগুনের সূত্রপাত। এরপর থেকে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থা এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় মঙ্গলবার দুপুরের আগে নিয়ন্ত্রণে আসে। এদিকে আগুন ও বিস্ফোরণে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ডিপোর ভেতর থেকে নিহত আরও দুজনের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৪৩। এর আগে ৪১ জনের লাশ উদ্ধারের তথ্য নিশ্চিত করে প্রশাসন। নতুন উদ্ধার হওয়া দুজনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। তবে এর মধ্যে একজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২২ জনের লাশ শনাক্তে গ্রহণ করা হয়েছে ৩৯ জনের নমুনা।

শনাক্ত হতে সময় লাগতে পারে অন্তত এক মাস। ততদিন পর্যন্ত লাশগুলো থাকবে চমেক হাসপাতালের মর্গে।

এখন পর্যন্ত শনাক্ত ২৬ জনের লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছিল ১৬ জনকে। এদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।

বিস্ফোরণের তিনদিন পর বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। এদিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আরিফুল ইসলাম ঘটনাস্থলে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘এখন শুধু ধোঁয়া বের হচ্ছে। কিছু কাপড় বোঝাই কনটেইনার রয়েছে।

সেগুলো থেকে মাঝে মধ্যে আগুন দেখা গেলেও ছড়িয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এখানে প্রায় চার হাজারের মতো কনটেইনার ছিল। কনটেইনারগুলো একটার ওপর একটা সারি করে রাখা ছিল। সেনাবাহিনীর সহায়তায় নিচেরটি বাদ দিয়ে ওপরেরগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

নিচে যে কনটেইনার ছিল সেগুলোও একের পর এক সরানো হচ্ছে। সেনাবাহিনী এখন ফায়ার সার্ভিসকে নিয়ে ডাম্পিংয়ের কাজ শুরু করেছে। খুব সতর্কতার সঙ্গে এখানে কাজ হচ্ছে। যাতে নতুন করে কোনো বিস্ফোরণ না ঘটে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে তবে নতুন করে কিছু ঘটলে সেটি ভিন্ন ব্যাপার। আমরা কাজ করে যা বুঝতে পারছি, আপাতত বড় কোনো সমস্যা নেই। এখন যে কয়টি কনটেইনার পড়ে রয়েছে সেগুলোতে কাজ করলে বোঝা যাবে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলেছে, ওইসব কনটেইনারে কাপড় রয়েছে। আমরাও দেখছি যেগুলো থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আর মাঝে মধ্যে আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছে। এটাও অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধ হবে।’

বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারানো আরও দুজনের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে ডিপোর মাঝখানে তাদের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে একজন দমকলকর্মী ও অন্যজন ডিপোর নিরাপত্তা প্রহরী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেহাবশেষের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় পুড়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি মোবাইল সেট।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, পৃথক দুই স্থান থেকে দুজনের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। একজনের শরীরে ফায়ার সার্ভিসের পোশাক ও হেলমেট রয়েছে। তাই ধারণা করছি এটি কোনো ফায়ার সার্ভিসকর্মীর হতে পারে।

আরেকজনের দেহে নিরাপত্তা রক্ষীর কিছু চিহ্ন রয়েছে। তিনি বিএম ডিপোর কর্মী হতে পারেন। তবে কারও লাশই চেনার উপায় নেই। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া পরিচয় বের করা সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, আগুন এখন নির্বাপণের শেষ পর্যায়ে। আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছি। পানি ছিটানো বন্ধ করলে তাপমাত্রা বেড়ে আবার কিছু আগুনের ফুলকি বের হতে দেখা যায়।

ডিপোতে আর কেমিক্যাল থাকার কথা নয়। তাই অনেকটাই বিপদমুক্ত। আমরা ডিপো কর্তৃপক্ষকে বলেছি, তারা যেন নিজস্ব ফায়ার ফাইটার দিয়ে পানি ছিটানো অব্যাহত রাখে।

গত শনিবার রাতে ডিপোটিতে আগুন লাগে। ভয়াবহ বিস্ফোরণে দগ্ধ ও আহত হয়ে এ পর্যন্ত দমকল কর্মীসহ মৃত্যু হয়েছে ৪৩ জনের। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। আহতদের অনেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সংকটাপন্ন কয়েকজনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। ডিপোটিতে রপ্তানিমুখী হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে এক পর্যায়ে আগুন নির্বাপণে যোগ দেয় সেনাবাহিনী।

নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনদের ভিড়, ৩৯ জনের নমুনা প্রদান : বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে মঙ্গলবারও হাসপাতালে ভিড় করেছেন তাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরা।

চমেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার সেন্টারের সামনে দ্বিতীয় দিনের মতো ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কার্যক্রম চালানো হয়। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজটি করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত ২২ জনের খোঁজে ৩৯ জন নমুনা দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ২৬টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এসব লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।

নমুনার ফলাফল পেতে অন্তত এক মাস সময় লাগতে পারে। ততদিন পর্যন্ত লাশগুলো চমেক হাসপাতালের ফ্রিজারে সংরক্ষণ করা হবে।’ দ্বিতীয় দিনের মতো মঙ্গলবারও চমেক হাসপাতালের সামনে নিখোঁজদের সন্ধানে ভিড় করতে দেখা যায় স্বজনদের।

অনেকেই অবস্থান করেছেন নিখোঁজদের ছবি সংবলিত ব্যানার নিয়ে। নিখোঁজ ব্যক্তির পিতা-মাতা, সন্তান অথবা ভাইয়ের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডি সদস্যরা।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক ল্যাব) রুমানা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ২২ জনের সন্ধানে ৩৯ জন স্বজনের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সাধারণত ব্লাড থেকে ডিএনএ নমুনার ফল পেতে সহজ হয়। কিন্তু পোড়া লাশের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে চুল, দাঁত কিংবা হাড়ের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর ফলাফল পেতে কমপক্ষে এক মাস সময় লেগে যেতে পারে।’

বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১৬, চরম সংকটাপন্ন ৩ জন : বিএম ডিপোতে অগ্নিদগ্ধ ১৯ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছিল।

এর মধ্যে মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন আছেন ১৬ জন। এদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন ৩ জন। মঙ্গলবার দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সীতাকুণ্ডের ঘটনার পর থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত ঢাকায় ১৯ জনকে আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। খালিদুর রহমান নামে আরেকজন করোনা পজিটিভ হওয়ায় ঢামেকের কোভিড ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।

বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১৬ রোগীর মধ্যে তিনজন আইসিইউতে রয়েছে। একজন লাইভ সাপোর্টে এবং বাকিরা পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে আছেন।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রোগীদের প্রায় সবারই চোখে সমস্যা রয়েছে একই সঙ্গে কমবেশি শ্বাসনালি পোড়া আছে। চোখের বিষয়টি ঢামেকের চিকিৎসকরা দেখছেন।

দগ্ধ খালেদুর রহমান (৫৮) করোনা আক্রমণ হওয়ায় মঙ্গলবার তাকে ঢামেক হাসপাতাল করোনা ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ৮৭ জন দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা চলছে। এ নিয়ে সব মিলিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ১০৬ জন।

দগ্ধরা যতদিন চিকিৎসা নেবেন, খরচ দেবে সরকার-চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক : বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে যারা দগ্ধ হয়েছেন তাদের চিকিৎসার পুরো ব্যয়ভার বহন করবে সরকার।

যতদিন তাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে, ততদিন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওষুধ ও চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সামনে স্থাপিত সহায়তাকেন্দ্রে প্রেস ব্রিফিং করে এসব কথা বলেন তিনি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/559739