৭ জুন ২০২২, মঙ্গলবার, ১০:৫৮

সার নিয়ে কৃষিতে উদ্বেগ বাড়ছে

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে সার আমদানিতে সমস্যা চলমান; অস্বাভাবিক হারে গ্যাসের দাম বাড়ায় ইউরিয়া সারের নিজস্ব উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে এমনিতেই সার আমদানি নিয়ে নানাবিধ শঙ্কা ও সঙ্কট রয়েছে। যদিও কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, সার আমদানিতে খরচ বৃদ্ধি ছাড়া কোনো সমস্যা নেই। সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সারে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে এবার সারের দেশীয় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনিতেই লোকসানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি সার কারখানা। এর ওপর কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য প্রায় ২৬০ গুণ বৃদ্ধি করায় উৎপাদনব্যয় বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে। ফলে লোকসানও বাড়ছে। এ অবস্থায় চাহিদা মোতাবেক সরকারি সারকারখানাগুলো ইউরিয়া সার উৎপাদন করতে পারবে কিনা তা নিয়েও উদ্বেগ সংশ্লিষ্টদের। এতে দেশের কৃষি খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমদানি সার নিয়ে অনিশ্চয়তার সাথে যদি দেশীয় উৎপাদন ব্যাহত হয় তাহলে কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদনও ব্যাহত হবে। এতে খাদ্যসঙ্কট দেখা দেয়ার সমূহ শঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, দেশে প্রতি বছর সাড়ে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে উৎপাদন হয় প্রায় ১০ লাখ টন। চাহিদার বাকিটা আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতার থেকে আমদানি করা হয়। টিএসপি সার প্রয়োজন হয় সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু দেশে উৎপাদন হয় এক লাখ মেট্রিক টন। বাকিটা মরক্কো, তিউনিসিয়া থেকে আমদানি করা হয়। ডিএপি সারের প্রয়োজন হয় সাড়ে ১৬ লাখ। তার মধ্যে সাড়ে ১৫ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয়। যার বেশির ভাগই আসে চীন ও জর্দান থেকে। এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে আট লাখ টন, যার পুরোটাই বেলারুশ, রাশিয়া, কানাডা থেকে আমদানি করা হয়। ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বেশ কয়েকটি দেশ থেকে সার আমদানিতে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ভিন্ন দেশ থেকে আমদানির সার আনার চেষ্টা করছে। ইউরিয়া সারের মধ্যে দেশীয় নিজস্ব উৎপাদন থেকে প্রায় ১০ লাখ টন সরবরাহের টার্গেট রয়েছে। কিন্তু গ্যাসের মূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ায় এখানেও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।

গত রোববার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন সব পর্যায়ের গ্রাহকদের জন্য গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সার কারখানার গ্যাসের দাম, ২৫৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ। দাম ঘোষণার সময় এক প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু ফারুক বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে কোনো খাতেই উৎপাদন পর্যায়ে তারা ভর্তুকি দেবে না। এতদিন সার কারখানাগুলো ভর্তুকি দামে গ্যাস পেত। এই ভর্তুকি উঠে যাওয়ায় তাদের গ্যাসের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। আগে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের জন্য সার কারখানাগুলো ৪ টাকা ৪৫ পয়সা করে দিত। এখন দিতে হবে ১৬ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই দেশের সরকারি সার কারখানাগুলোতে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করেও প্রত্যাশিত ইউরিয়া সার উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। লোকসান গুনতে হচ্ছে। সার কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ অনেক বাড়বে।

এ বিষয়ে বারবার ফোন ও এসএমএস দিয়েও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) চেয়ারম্যান শাহ মো: ইমদাদুল হকের সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা ২২ টাকায় ১ ইউনিট ইউরিয়া উৎপাদন করি এবং তা ১৪ টাকায় বিক্রি করি। এজন্য লোকসান হয়। তবে বিসিআইসির পরিচালক (উৎপাদন ও গবেষণা) মো: শাহীন কামাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এটা নিয়ে নিশ্চয় সরকার বিবেচনা করছে বা আরো করবে। পেট্রো বাংলাও সরকারের, বিসিআইসিও সরকারের, অসুবিধা তো নেই। তিনি বলেন, আগে গ্যাস যা লাগত, এখনো তাই লাগবে। শুধু খরচ বেড়ে যাবে। এই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে আমদানির সারে প্রতি টনের ক্রয়মূল্য ৬৫-৭০ হাজার টাকা পড়ছে। ১৪ হাজার টাকা বাদ দিলে ৫২ হাজার টাকাই ভর্তুকি দিতে হয় সরকারকে। নিজস্ব উৎপাদনে আগে গ্যাস প্রাপ্তিতে সমস্যা ছিল, বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত দুই মাসে গ্যাস প্রাপ্তিতে কোনো সমস্যা হয়নি। ভালো সাপোর্ট পাচ্ছি আমরা।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ বিভাগের উপপ্রধান (কৃষি অর্থনীতিবিদ) শেখ বদিউল আলম বলেন, সরকারের এক পকেটের টাকা আরেক পকেটে ঢুকবে। ফলে গ্যাসের দাম বাড়াতে সরকারি সার সরবরাহে সমস্যা হবে না মনে করি। তবে সার উৎপাদন খরচটা বাড়বে। বিসিআইসি যে উৎপাদন করে, তাতে কোনো ভর্তুকি দেয়া হয় না। তাদের কাছ থেকে আমরা সার কিনি। তবে সাপ্লাই চেইনে সমস্যা হবে না।
তিনি জানান, এবার মোট ২৬ লাখ টন ইউরিয়ার সারের চাহিদা আছে। বিপরীতে বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ টন ইউরিয়া মজুদ আছে। নিজস্ব উৎপাদন প্রায় ১০ লাখ টন, বাকি প্রায় ১৬ লাখ টন আমদানি করতে হয়। গত ১৬ মে প্রায় ১০ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানির টেন্ডার দেয়া হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। কোন দেশ থেকে এই সার আসবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কে কোন দেশ থেকে আমদানি করতে পারবে তা তাদের (আমদানিকারক) বিষয়।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/668643