৭ জুন ২০২২, মঙ্গলবার, ১০:৫৬

বার্ন ইনস্টিটিউটে দগ্ধদের আর্তনাদ : বাইরে অঝোর কান্না পরিবারের

ত্রিশ বছরের যুবক ফরমানুল ইসলাম। এক ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে রিসিভার হিসেবে কাজ করতেন ফরমানুল। শনিবার রাতের ভয়াবহ বিস্ফোরণে সব কিছু এলোমলো হয়ে যায় তার। সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো পোড়া ক্ষত শরীর নিয়ে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে কাতরাচ্ছেন তিনি। ‘ডাক্তাররা শরীরের অনেক মাংস কেটে ফেলছে। অনেক ইনজেকশন দিছে। ভালো মতো তাকাতেও পারছি না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হয় আর বাঁচব না। বাবা-মাকে বইলেন দোয়া করতে। আপনারাও দোয়া কইরেন, আমি যেন বেঁচে থাকি’। আইসিইউতে এভাবেই চাচীর কাছে বেঁচে থাকার আর্তনাদ জানান ফরমানুল ইসলাম। চাচী ফরিদা ইয়াসমিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। কয়েক মিনিটের জন্য কষ্ট চেপে রেখে আইসিইউ ওয়ার্ডের বাইরে এসে চিৎকার করে কান্না শুরু করেন। তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে চোখের পানি ফেলেছেন ফরমানুলের অন্য স্বজনরাও।

শুধু ফরমানুলই নয়, মর্মান্তিক ঘটনায় যাদেরকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে বেশির ভাগই স্বজনদের কাছে বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছেন। আর স্বজনরা সান্ত্বনা দিয়ে এসে আহাজারিতে ভেঙে পড়ছেন। গতকাল দুপুরে ইনস্টিটিউটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে ফরমানুলের চাচী ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, দুই পায়ের রান ও পেছনের অংশ থেকে অনেক মাংস কেটে ফেলছে। ঠোঁট ও চোখ পুড়ে গেছে। ভালো মতো তাকাতেও পারেনি। শুধু বলল, বাবা-মাকে দোয়া করতে বলবেন, বলেই কান্না শুরু করেন তিনি। তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে চোখের পানি ফেলছিলেন, ফরমানুলের বন্ধু বেলাল, খালু রশিদ আহমেদ ও চাচাতো ভাই সোহেল শিকদার। তারা জানান, সীতাকুণ্ডের ওই ডিপোতে রিসিভার হিসেবে কাজ করতেন ফরমানুল। বাড়ি বাঁশখালি। বাবার নাম নাসির হোসেন। এক ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার বড় সে।

ফরমানুলের স্বজনদের মতোই কান্না করতে দেখা যায় দগ্ধ গাউছুল আজমের স্ত্রী নাজমা ইসলামকে। একই রকম চিত্র দেখা যায় পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের সামনে। ওয়ার্ডটির সামেন লিফটের পাশে বসে কান্না করছিলেন দগ্ধ নজরুল ইসলামের স্ত্রী রূপা বেগম। কান্না করতে করতে তিনি বলেন, ভেতরে গেছিলাম। উনি (স্বামী) ভালো মতো কথা বলতে পারতাছে না। বারবার মেয়েদের দেখতে চাচ্ছে। আর দোয়া করতে বলছে। উনার কিছু হয়ে গেলে মেয়েদের নিয়ে রাস্তায় বসতে হবে। ডাক্তাররা বলছে, ভালো হয়ে যাবে। সেই আশায় বসে আছি। তার পাশেই ছোট মেয়ে হাবিবাকে আব্বু যাবো আব্বু যাবো বলে ঘুরাঘুরি করতে থাকলে, হাবিবাকে জড়িয়ে ধরে আবারো কান্নায় ভেঙে পড়েন রূপা বেগম।

এদিকে, বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় রাজধানীর বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া রোগীর বেশির ভাগই আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১২টায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম। বর্তমানে ১৪ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গতকাল সোমবার ভোর পর্যন্ত মোট ১৫ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন গুরুতর দগ্ধ না হওয়ায় ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকি ১৪ জন এখানে ভর্তি রয়েছেন। বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১৪ জনের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা: আবুল কালাম জানান, তাদের মধ্যে চারজন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) আছেন। চারজনের অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। এদের মধ্যে ১৩ জনের চোখ ‘হাইলি এফেক্টেড’ হয়েছে। তাদের চিকিৎসায় ঢামেকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। ১০ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সেই সাথে ঢামেক থেকেও চিকিৎসকরা এসে তাদের দেখে গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এখান থেকে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেনের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি দল বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রয়েছেন। ওখান থেকে আরো ৭-১০ জন রোগী এখানে পাঠানো হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।

আমাদের ঢামেক প্রতিনিধি জানান, গতকাল দুপুরে সজীব নামে আরো একজনকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছে। এ নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ জনে। আর রাসেল নামে যাকে ঢাকা মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়েছিল তিনি চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন।

দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী : সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল দুপুরে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে আহতদের দেখতে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এরপর সাংবাদিকদের তিনি একথা জানান। মন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার সব হাসপাতালকে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। তারা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে এবং বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে একটি টিমও গেছে। চট্টগ্রামের টিম কাজ করছে। এখন চট্টগ্রামসহ অন্যান্য হাসপাতালেও কাজ করছে। যেসব রোগীর অবস্থা গুরুতর, তাদের প্রয়োজনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য আমরা বলেছি। যারা আসতে চাচ্ছেন, তাদেরকে আমরা নিয়ে আসছি। এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া ২০০ জন আহত হয়েছেন। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৯ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। নিহতদের সবার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। দুর্ঘটনার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী খোঁজখবর রাখছেন এবং নির্দেশনা দিচ্ছেন।

নিহতদের বেতন চলমান থাকবে : ডিপোর মালিকপক্ষ স্মার্ট গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের জিএম মো: মমতাজ উদ্দিন বলেছেন, নিহত প্রত্যেককে ১০ লাখ, অঙ্গ হারানো প্রত্যেককে ছয় লাখ, আহত প্রত্যেককে চার লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। পাশাপাশি নিহতদের যাদের ছোট বাচ্চা আছে, সে কর্মক্ষম হলে কোম্পানিতে চাকরি দেয়া হবে। তার আগ পর্যন্ত নিহত ব্যক্তি যে পরিমাণ বেতন পেতেন সেটি অব্যাহত রাখা হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/668623