৭ জুন ২০২২, মঙ্গলবার, ১০:৫১

আন্দোলন ইস্যু: প্রস্তুতি ও প্রকৃতি

-ড. মো. নূরুল আমিন

পেশাগত অবস্থানের কারণে বিভিন্ন ধরনের মানুষ আমাদের বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করেন। কেউ কেউ মনে করেন যারা সাংবাদিক তারা সব কিছু জানেন। আসলে আমরা তা নই। চাঁদের যেমন নিজের আলো নেই অন্যের আলো ধার করে দুনিয়াকে আলোকিত করে আমাদের অবস্থাও অনেকটা তাই।

অধুনা আন্দোলন নিয়ে কথা উঠেছে। সরকারের দুঃশাসন অবসানের আন্দোলন। দেশে-বিদেশে অনেকেই প্রশ্ন করেন আসলে কি আন্দোলন হবে? হলে কোন দিন থেকে? কি ধরনের আন্দোলন? আবার অনেকে বিএনপি’র নেতৃত্বের আন্দোলনের সামর্থ্য আছে কিনা তাও জানতে চান। কেউ কেউ জোট শরিক জামায়াতকে নিয়েও প্রশ্ন করেন। আবার যারা সরকারি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা তাদের অনুকম্পাপ্রাপ্ত থিংকট্যাংক, তারা আন্দোলনের ইস্যু নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তারা প্রকাশ্যে বলে বেড়ান যে, বাংলাদেশে এখন আন্দোলনের কোনো ইস্যুই নেই, দেশটি উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। পদ্মা নদীর ওপর পুল তৈরি করতে পেরেছি। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে ডাঙ্গায় রাস্তার ওপর শত শত কোটি টাকা খরচ করে অসংখ্য ওভারব্রিজ আমরা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এসব প্রশ্নের উত্তর সহজে দিতে পারি না। যেমন পারি না যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে বিগত ২০১৪-এর জানুয়ারির নির্বাচনে আমি কোথায় ভোট দিয়েছি। আমি কেন, আপনি আমাদের মাননীয় প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, স্পীকার শিরীন শারমিন, অথবা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে প্রশ্ন করুন, আপনারা কোথায় ভোট দিয়েছেন? আমার বিশ্বাস তারা কেউ বলতে পারবেন না যে, তারা ভোট দিয়েছেন। কেন না আমার মতো তাদের নির্বাচনী এলাকাতেও ভোট হয়নি। বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য এমন এক অদ্ভুত ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে ১৫৪ জন সদস্য বিনা ভোটেই নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ১৪৬টি নির্বাচনী এলাকায় একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন হয়েছে যাতে ৪০টি নির্বাচন কেন্দ্রে সারা দিনে একজন ভোটারও ভোট দিতে আসেননি। অন্যান্য কেন্দ্রে ভোটার টার্ন আউট ছিল ৫ থেকে ১০ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, জনগণ তো বটেই তিনি নিজের, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। ১৪৬টি আসনে নির্বাচনের আসলে দরকার ছিল না। এতে আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়েছে মাত্র। ৩০০ আসনের ১৫১ আসন পেলেই সরকার গঠন করা যায়। তিনি বিনা ভোটে তার থেকে বেশি আসন পেয়েছিলেন। আর ভাতের কথা। আমি মাঝারি মানের যে চালের ভাত খেতাম তার দাম ছিল ১৫ টাকা কেজি। তা এখন ৬৮/৭০ টাকা। মাছ, গোশ্ত, তরিতরকারি, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, তেল, নুন ও অন্যান্য মসলা প্রভৃতির দাম তার ক্ষমতায় আসার আগের তুলনায় গড়ে হাজার গুণ বেড়েছে। আমি তো আল্লাহর রহমতে খাচ্ছি, কিন্তু অনেক পরিবার আছে যারা দু’বেলা খেতেও পাচ্ছেন না। ভোট এবং ভাতের অধিকার আমরা এভাবে পেয়েছি। ২০১৪ সালে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসেনি। ২০১৮ সালে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে দেয়া হয়নি। আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় কিছু রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে যাতে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের মাত্রা ৫০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্যাংক-বীমা, নৌ-পরিবহন, বিমান, রেলসহ সরকারি মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোর লুটপাট ও দুর্নীতি কত হাজার গুণ বেড়েছে বিরোধী দলের কোন গবেষণা সেল থাকলে সহজে তার তথ্য পাওয়া যেত। তথাপিও যা পত্রিকায় আসছে তাতে সরকারে ডাকাত ছাড়া আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। এটা মানুষ বলে থাকে আমার কথা নয়। যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে এত রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে আওয়ামী লীগ পদদলিত করেছে।

পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান যাকে আমরা খুনি বলি তিনিও কিন্তু সত্তর সালের নির্বাচনে কাউকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি। সম্পূর্ণ হস্তক্ষেপমুক্ত ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন করেছিলেন। আজকে পত্রিকার পাতা উল্টালে দেখা যায় এমন দিন নেই যেদিন খুন, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটছে না। মানবাধিকার পুলিশের বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছে। শাসক দল ও তার অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ প্রভৃতি লীগধারীদের চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, উন্নয়ন প্রকল্পে হরিলুট, শিক্ষাঙ্গনের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, ভর্তি বাণিজ্য ও সর্বত্র নিয়োগ বাণিজ্য, দলীয়করণ প্রভৃতি জাতীয় জীবনের প্রতিটি খাতকে শুধু বিপন্ন নয়, ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীন, সম্মানজনক অস্তিত্ব এখন বিপন্ন।

ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অনৈতিক কর্মকা- নিয়ে স্বয়ং আওয়ামী লীগ ঘেঁষা পত্রিকাগুলোও গত ১২ বছর ধরে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়ে আসছে। বিশেষ রিপোর্ট, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, এমনকি বিশেষ সংখ্যা পর্যন্ত তারা প্রকাশ করেছে। কিন্তু এই সংগঠনটি ও তার নেতৃবৃন্দ শাস্তি পায়নি।

আমি এতক্ষণ পর্যন্ত যে বিষয়গুলো উল্লেখ করলাম তার কোনটি অসত্য? এগুলো কি আন্দোলনের ইস্যু নয়? একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তার সাথে আমার কথা হচ্ছিল। অনেক কথার মধ্যে তার একটি কথা আমার মনে দাগ কেটেছিল। তিনি বলেছিলেন, বর্তমান সরকার বিরোধী দলের হাতে যতগুলো ইস্যু তুলে দিয়েছে তার অর্ধেকও যদি আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে পেতো তাহলে তারা বাংলাদেশের মাটি উল্টে দিতো। কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। সম্ভবত এ কারণে আওয়ামী লীগ নেতারা তিরস্কার করে বলে থাকেন যে, বিরোধী দলের আন্দোলন করার কোনো মুরোদ নেই।

আজ দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের অনেকগুলো জেলা সফর করেছি। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকের সাথে আলোচনা করে মাঠের উত্তপ্ততা আমি অনুভব করেছি। মাঠ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। দেশের মানুষ দুঃশাসন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস থেকে মুক্তি চায়, প্রশ্ন হচ্ছে গলায় ঘণ্টা বাঁধার। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্ব আন্দোলনের ব্যাপারে সুসংগঠিত কিনা অনেকে প্রশ্ন করেন। তবে তাদের কর্মী ও সাপোর্টার বেজ যে সংগঠিত এবং নিবেদিতপ্রাণ তাতে সন্দেহ নেই। জামায়াত তার অবস্থানে দৃঢ়। তবে নানা গুজব ছড়িয়ে সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা তাদের ব্যাপারে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। নূর এবং মান্নার দলও এগিয়ে এসেছে। বিরোধী দল যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তাহলে আন্দোলন অবশ্যই এগিয়ে যাবে।

অনেকে বিশেষ করে আওয়ামী লবীর সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলন হলে তা সহিংস হবার জিগির তুলে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির কসরত করে যাচ্ছেন। সহিংস আন্দোলন কারোরই কাম্য নয়। আবার যদি সরকারের তা কাম্য হয় তাহলে আন্দোলন অহিংস থাকতে পারে না। এটা অতীতের অভিজ্ঞতা। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে যখন সরকার বাধা দিয়েছে, পুলিশ বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার দিয়ে দমানোর চেষ্টা করেছে তখন আন্দোলনকারীরা আত্মরক্ষার জন্য উগ্রতা প্রদর্শন করেছে। হরতাল অবরোধ গণবিরোধী। প্রশ্ন হচ্ছে, গণবান্ধব কর্মসূচি কোনটি? সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল গণতান্ত্রিক অধিকার। তা করতে দিবেন না।

গণসংযোগ, পথসভা মানববন্ধন করতে গেলে র‌্যাব পুলিশ ও দলীয় গু-াদের দিয়ে মানুষের ঠ্যাং ভেঙে দেবেন। অবস্থান ধর্মঘট, অনশন প্রভৃতিও সহ্য করতে পারবেন না। মহাসমাবেশ করতে গেলে সরকার ও তার দল অনানুষ্ঠানিকভাবে রাজপথ, রেলপথ, নৌপথ বন্ধ করে দেবেন। তাহলে বিক্ষুব্ধ মানুষ কি করবে? পথ বাতলে দিন।

সরকারি নির্দেশনা ও চাহিদা অনুযায়ী দুনিয়ার কোথাও অধিকার আদায়ের আন্দোলন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের দেশ থেকে গণতন্ত্রকে আওয়ামী লীগ যেমন উচ্ছেদ করেছে তেমনি চিরায়ত কিছু প্রথাও ধ্বংস করে দিয়েছে। পাবলিক মিটিং-এর নির্দিষ্ট কোনো ভেন্যু এখন নেই। মাইকিং পাবলিসিটি নেই।

গণতন্ত্র পুলিশ কমিশনারের হাতের মুঠোয় বন্দী। এই গণতন্ত্র রক্ষা মানবাধিকার পুনরুদ্ধার, সংবিধানের মূলনীতিতে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসের পুনঃসংযোজন, খুন, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধকরণ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয়করণের অবসান ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর জুলুম-নির্যাতন বন্ধ, মানবতা বিরোধী অপরাধের মিথ্যা অভিযোগে বরেণ্য রাজনীতিক ও আলেমদের বিচার ও বিচারের রায় বাতিলকরণ, সাগর-রুনিসহ সাংবাদিক হত্যার বিচার, সরকারের দুর্নীতিবাজদের বিচার প্রভৃতি ইস্যুগুলো বিরোধী দলের সামনে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোকে সংহত করে দাবির আকারে সরকারের কাছে আগে থেকে পেশ করা আছে। প্রয়োজনবোধে পুনরায় তা পেশ করে সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন শুরু করার এখনই উপযুক্ত সময়। আন্দোলনকে অহিংস রাখার দায়িত্ব সরকারের বলেই আমি মনে করি। সরকারি দল আন্দোলনের আগেই তা দমনের হুমকি দেয়া শুরু করেছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। আওয়ামী লীগ অত্যাচার-নিপীড়ন, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানুষকে যে হারে বাড়ি ছাড়া করেছে তাতে ক্ষমতায় না থাকলে তাদের কি অবস্থা হতো তা নিয়ে তারা শঙ্কিত। যারা আন্দোলন করবেন তাদেরকে এ কথাগুলো অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। এ ব্যাপারে মন্ত্রী-এমপিদের আয় ও সম্পদের একটা খ-চিত্র কেউ কেউ পছন্দ করতে পারেন।

পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মন্ত্রী এমপিদের আয়-ব্যয়ের একটি চিত্র তুলে ধরেছিলেন। বলাবাহুল্য, দশম সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থী ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক দল নমিনেশন পেপার দাখিল করেনি। ৩০০ আসনে মনোনয়ন দাখিলকারীদের সংখ্যা ছিল ১১০৭ এবং ১৫৪টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ১৪৬টি আসনে ৩৮৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রের সংগে হলফনামা আকারে আয়কর বিবরণীসহ ৮ ধরনের তথ্য রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে দাখিল করেছেন।

তাদের প্রদত্ত ২০০৮ ও ২০১৩ সালের তথ্যের ভিত্তিতে আয়, সম্পদ, দায়-দেনা ও পারিবারিক ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, ৪৮ জন সাধারণ প্রার্থীর আয় গড়ে ৫৮২ ভাগ বেড়েছে। এই হার মন্ত্রীদের বেলায় ২৪৩ ভাগ, প্রতিমন্ত্রীদের বেলায় ৪৬৪ ভাগ এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা, চীফ হুইপ ও হুইপের ক্ষেত্রে ৩০৭১ ভাগ। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও ডেপুটি স্পীকারের আয় বেড়েছে যথাক্রমে ১৩৬ ও ৪৪৩৫ ভাগ। শতকরা হারে আয় বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে সুজন সম্পাদক বলেন যে, আওয়ামী লীগ নেতা নূর ই আলম চৌধুরীর আয় বেড়েছে ৩২৯৮৫ ভাগ, আবদুল মান্নান খানের ৮৪২২ ভাগ, মাহবুবুর রহমানের ৮০০৭ ভাগ, ডেপুটি স্পীকার শওকত আলীর ৪৪৩৫ ভাগ, ড. হাসান মাহমুদের ২০৩৬ ভাগ এবং আফসারুল আমীনের ২৪৮০ ভাগ। বলাবাহুল্য, এ তথ্য তাদের দেয়া; যদি তদন্ত করা হয় তা হলে আয় বৃদ্ধির এই হার নিশ্চিতভাবে আরো কয়েক হাজার গুণ বৃদ্ধি পাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

আয়ের পরেই সুজন সম্পাদক হলফনামায় প্রদর্শিত তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া প্রার্থী ও তাদের নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির বিবরণী তুলে ধরেছিলেন। তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে, ৪৮ জন প্রার্থীর ৫ বছরে গড়ে সম্পদ বেড়েছে ৩৬৩ ভাগ। এই হার মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ২৪৭ ভাগ, প্রতিমন্ত্রীদের ক্ষেত্রে ৪৫৯ ভাগ এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা, চীফ হুইপ ও হুইপদের ক্ষেত্রে ১৬৮৯ ভাগ। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও তাদের মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির সংখ্যা আমাদের দেশে প্রায় ৭৭ জন। সুজনের তথ্যানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ৪৬ ভাগ, ডেপুটি স্পীকারের ২৩৮ ভাগ, মন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের সম্পদ বেড়েছে ১০৯৯৭ ভাগ, নূরে আলম চৌধুরীর ৬৪২৪ ভাগ, ড. হাসান মাহমুদের ৩৮৯২ ভাগ, লতিফ সিদ্দিকীর ১৯৬৯ ভাগ, মীর্জা আজমের ১৪১৪ ভাগ, মাহবুবুর রহমানের ১২৬৩ ভাগ এবং ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের বেড়েছে ১১৩৫ ভাগ। তিনি টাকার অংকে সম্পদ বৃদ্ধির একটি বিবরণীও দিয়েছেন। এই বিবরণী অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের একজন শীর্ষ ব্যক্তির সম্পদ বেড়েছে ৪১ কোটি ৪৮ হাজার ৩৪৬ টাকার, মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ৩২ হাজার ৯৪১ টাকার, ড. হাসান মাহমুদের ১৪ কোটি ৮৫ লাখ ৭৪ হাজার ৫২৬ টাকার, ডা. রুহুল হকের ১০ কোটি ২৯ লাখ ৭৬ হাজার ৭০০ টাকার, সুরঞ্জিত সেনের ৭ কোটি ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার ২০৬ টাকা। আবদুল মান্নান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুবুর রহমান, প্রত্যেকের গড়ে সোয়া সাত কোটি টাকা করে। স্থান সংকুলানের অভাবে এখানে সকলের বিবরণী আমি উল্লেখ করলাম না। আগেই বলেছি এটা তাদের নিজেদের দেয়া তথ্য, পূর্ণাঙ্গ সত্য বা অর্ধ সত্যও নয়, হয়ত এক আনা বা তার কম সত্যও হতে পারে। নামে বেনামে তাদের আয় ও সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে সবাই তা জানেন। মন্ত্রী-এমপি, তাদের সন্তান ও আত্মীয়দের দুর্নীতির খবর প্রতিনিয়ত এখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এই অর্থ কার? অবশ্যই জনগণের, যারা এদেশের মালিক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদের ৩ উপ-অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিসহ ৮টি সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিদের বেতনভাতার বাইরে অন্যসব আয়ের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপিত আছে। তাদের বেতন-ভাতাও সংসদের আইন দ্বারা নির্ধারিত। সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতার পরও মন্ত্রীদের আয় ও সম্পদ যে হারে বেড়েছে তা শুধু অস্বাভাবিক নয়, বিস্ময়করও। একজন বিচারকের দুর্নীতি ও যুক্তরাজ্যে ছয়টি বাড়ি ক্রয়ের বিবরণী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরও কোনও তদন্ত হয়নি বরং তথ্য প্রদানকারী জেলে মানবেতর জীবন যাপন করেছেন। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্পষ্টত সংবিধান লঙ্ঘন করছেন। দেশ পুনরায় একটি লুটপাট সমিতিতে পরিণত হয়েছে। যারা রক্ষক তারা যদি ভক্ষক হন, দুর্নীতি, সম্পদ আত্মসাৎ ও সংবিধান লঙ্ঘনে জড়িত হয়ে যান তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ বলে কিছু আর থাকতে পারে না। এই অবস্থায় দেশ ও জনগণকে রক্ষার দু’টি পন্থা থাকে। একটি হচ্ছে সরকারের সংশোধন, সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়া এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সরকার হটানোর আন্দোলন। বাংলাদেশে প্রথমোক্তটি ব্যর্থ হয়েছে। এখন দ্বিতীয় পন্থা অনুসরণ ছাড়া আর কোন বিকল্প আছে বলে কেউ মনে করেন না। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদের সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ দল ও সহযোগী সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি ও সম্পত্তির হিসাব জাতির সামনে আসলে আন্দোলন অবশ্যই বেগবান হবে।

https://dailysangram.info/post/491502