চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দগ্ধদের আর্তনাদের সঙ্গে চলছে স্বজনদের আহাজারি। গতকাল তোলা। ছবি
৬ জুন ২০২২, সোমবার, ১২:০৫

এত পোড়া রোগী দেখেনি কেউ

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালজুড়ে আহাজারি। রোগীদের আর্তনাদ। হতাহতদের স্বজনদের কান্না। কেউ বা কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়জনকে খুঁজে বেড়ান।

রোগীদের সামলাতে হিমশিম খান চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। দিনে কাজ শেষ হলেও আবার রাতেই ছুটে আসেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে এগিয়ে আসেন অনেকে।
গত শনিবার রাতে নগরের উপকণ্ঠে সীতাকুণ্ডের বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল রবিবার দিনভর ছিল এই চিত্র।

বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকার ছয়টি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১১০ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯৬ জন। বাকি ১৪ জন ভর্তি আছেন ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

দুপুরে সাংবাদিকদের কাছে ব্রিফিংয়ে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পর এ পর্যন্ত আনুমানিক ২০০ জনকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আনা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। আহতদের মধ্যে ১৫ জনকে (ফায়ার সার্ভিসের সদস্য) সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়েছে। আইসিইউতে চারজন চিকিৎসাধীন ব্যক্তির মধ্যে দুজন চট্টগ্রাম মেডিক্যালে এবং অন্য দুজন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। আহত সাত-আটজন পুলিশ সদস্য নগরের পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এ ছাড়া আহতদের মধ্যে চমেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটসহ বিভিন্ন বিভাগে ৭০ জন ও চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে দুজন চিকিৎসাধীন।

একসঙ্গে এত রোগী দেখেনি কেউ

চমেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে একসঙ্গে এত রোগী ভর্তি হতে আগে কখনো কেউ দেখিনি। গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শ্বাসনালীসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোড়ার যন্ত্রণায় কাতর রোগীরা বার্ন ইউনিটে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছেন না। শয্যার অভাবে ৪৪ জন দগ্ধ রোগীকে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের (প্রসবোত্তর পরিচর্যা) একটি অংশে (আলাদা করে) রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় ভর্তীকৃত বার্ন রোগীদের মাত্র আটজন ওই ইউনিটে শয্যা পেয়েছেন। এসব রোগীকে প্রয়োজনীয় জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কথা থাকলেও আইসিইউ শয্যা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতাসহ নানা সংকটের কারণে রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না।

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৩ থেকে ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া এসব রোগীর সবার অবস্থা সংকটাপন্ন। তবে এখন পর্যন্ত আমরা সফলভাবে চিকিৎসাসেবা দিতে পারছি। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। ’

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘আহতরা আসার খবরে অনেক চিকিৎসক নিজেরাই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত হয়ে পড়েন, যা আমি ৩২ থেকে ৩৫ বছরে দেখিনি। ’

সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় গতকাল রাত সোয়া ৮টা পর্যন্ত রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ফায়ার সার্ভিসের দুজন কর্মী, বর্তমান ও সাবেক দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জন ভর্তি রয়েছেন। তাঁরা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) কামরুল হাসান ও সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এ কে এম মাখফারুল এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মী গাউসুল আজম ও রবিন মিয়া।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সীতাকুণ্ডের ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় যাঁরা দগ্ধ হয়ে এই ইনস্টিটিউটে এসেছেন, তাঁরা কেউই শঙ্কামুক্ত নন।

দায়িত্ব পালনকালে দগ্ধ এসআই

শিল্প পুলিশের এসআই কামরুল হাসান (৩৭) ছয় মাস আগে সীতাকুণ্ডে বদলি হন। গত রাতে তিনি ডিপোতে দায়িত্বে ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় লোকজনকে ডিপো থেকে সরানোর সময় হঠাৎ বিস্ফোরণে তাঁর আশপাশে কয়েকজন ছিন্নভিন্ন হয়ে যান। তাঁর পা পুড়ে যায়। গতকাল সকালে তাঁকে ঢাকায় আনা হয়।

সাবেক এএসপি মাখফারুলের দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত

ডিপোতে বিস্ফোরণে দগ্ধ সিকিউরিটি ম্যানেজার এ কে এম মাখফারুল ইসলাম। তাঁর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। পরিবারের সদস্যরা উৎকণ্ঠায় হাসপাতালে অপেক্ষা করছিলেন।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই দগ্ধ আমিন

ডিপোতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত থাকা বিস্ফোরণে দগ্ধ হন মো. আমিন। গতকাল বিকেলে ৫টার দিকে তাঁকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়। তবে তিনি কথা বলতে পারছেন। আমিন বলেন, রাতে বিস্ফোরণের ঘটনার সময় তিনি ডিপোর বাইরে একটি দোকানে বসে ছিলেন। হঠাৎ বিস্ফোরণে আগুনের কিছু একটা উড়ে তাঁর জননাঙ্গে লাগে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2022/06/06/1152901