৬ জুন ২০২২, সোমবার, ১১:৫১

ঋণ পরিশোধে শিথিলতা উঠে যাওয়ার প্রভাব

তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ল ১০ হাজার কোটি টাকা

ঋণ পরিশোধে শিথিলতা উঠে যাওয়ার পর বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। গত তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। গত মার্চে তা বেড়ে হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। শুধু খেলাপি ঋণের পরিমাণই বাড়েনি, এর হারও বেড়ে গেছে। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ, মার্চে এসে তা বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত দুই বছর খেলাপি ঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছিল। করোনাভাইরাসের ধকল কাটিয়ে ওঠার জন্য বলা হয়েছিল, কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি করা হবে না। এ শিথিলতা ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে বাড়তে বাড়তে গত বছরের ডিসেম্বরে এসে শেষ হয়। আর এ শিথিলতা উঠে যাওয়ার পর থেকেই খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসছে। এর প্রভাবেই গত মার্চ প্রান্তিকে এসে খেলাপি ঋণ এক লাফে ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, মার্চে এসে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে যা ছিল ১৩ লাখ এক হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে ব্যাংকিং খাতে ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণ পরিশোধ না করার সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছেন না কিছু ব্যবসায়ী। তারা ঋণ পরিশোধ না করে নানা ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে থাকেন; কিন্তু গত দুই বছর করোনাভাইরাস ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতার সুফল তারা পুরোপুরি নিয়েছিল। এক টাকাও ঋণ পরিশোধ না করে নির্বিঘেœ দুই বছর পার করে দেন তারা। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কেটে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার শিথিলতা তুলে নেয়। এর পর থেকেই খেলাপি ঋণ বাড়তে শুরু করেছে। তবে, ঋণ আদায় না বাড়লে জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ কোনো ঋণ পরিশোধ করছে না। নামে বেনামে ঋণ নিচ্ছে; কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধে নানা টালবাহানা করা হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের মন্দমানের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। মন্দমানের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছেন ব্যাংকাররা। কারণ এক দিকে মুনাফার চাপ, অপর দিকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ। ব্যাংকের পরিচালকরা চান মুনাফা; কিন্তু ঋণ আদায় না হলে মুনাফা হবে না। আর মুনাফা না হলে ডিভিডেন্ড কমে যাবে। এতে ব্যাংকের সুনাম নষ্ট হবে। অপর দিকে খেলাপি ঋণের ধরন অনুযায়ী ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। প্রভিশন সংরক্ষণ না করলে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দেবে।

সবমিলেই চাপের মুখে পড়ে যাচ্ছেন ব্যাংকাররা। আর এ চাপ কমছে না; বরং দিন দিন বাড়ছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতির মুখে পড়ার কথা বলে এরই মধ্যে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি না করার দাবি জানিয়েছে। আর এ দাবি নানা দিক থেকে করা হচ্ছে; কিন্তু ঋণ আদায় না করলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা যে কমে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কেউ ভাবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মার্চ শেষে রাষ্ট্রীয় সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ও বেসিকÑ এ ছয় ব্যাংকের মোট ঋণ দুই লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ২০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে রাষ্টীয় ছয় ব্যাংক মোট ঋণ দিয়েছে দুই লাখ ৩৩ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৪৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ১৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন মাসে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/668335