৬ জুন ২০২২, সোমবার, ১১:৪৯

গ্যাসের দাম বাড়ল ২২.৭৮ শতাংশ

সবচেয়ে বেশি সারে ২৬০ ভাগ; বেকায়দায় পড়বে কৃষি খাত; জনদুর্ভোগ বাড়ার আশঙ্কা

চাল, তেল, আটাসহ সবধরনের পণ্যের দাম ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। এতে বেড়েছে জনদুর্ভোগ। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে আরেক দফা জনদুর্ভোগ বাড়বে। সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার কথা হলো সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে। সারে ভর্তুকি না বাড়ালে সারের দাম বেড়ে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোগ্যপণ্যে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ সাধারণ জনগণের ঘাড়ে আরেক দফা পড়বে। এমনটাই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। আর শিল্প উদ্যোক্তাদের মতে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ধকল শিল্পোদ্যোক্তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে তারা আবারো বেকায়দায় পড়ে যাবেন। উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, বাড়বে পণ্যের মূল্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। তাদের মতে, গ্যাস চুরি বন্ধ করা গেলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না।

গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হলো। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম। এ খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতি ইউনিটে প্রায় ২৬০ শতাংশ। সার উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ২৫৯ শতাংশ, আবাসিকে মিটারযুক্ত গ্রাহকের ক্ষেত্রে প্রায় ৪৩ শতাংশ, মিটারবিহীন দুই চুলার ক্ষেত্রে ১০৫ টাকা অর্থাৎ পৌনে ১১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। অপর দিকে, বিদ্যুতে ১২ শতাংশ, ক্যাপটিভে সাড়ে ১৫ শতাংশ এবং বৃহৎ শিল্পে ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। নতুন এ দর চলতি জুন মাস থেকেই কার্যকর হবে। গতকাল রোববার ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন দর ঘোষণা করেন বিইআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু ফারুক। অন্যদের মধ্য অংশ নেন কমিশনের সদস্য মকবুল ই ইলাহী টৌধুরী, বজলুর রহমান ও কামরুজ্জামান।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্র ৬ কোটি ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো গেলে উচ্চমূল্যের জ্বালানি এলএনজি আমদানি করতে হতো না। এতে বাড়াতে হতো না গ্যাসের দাম। অথচ গত কয়েক বছরে দেশে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। যার খেসারত পোহাতে হচ্ছে দেশের জনগণের।

গতকাল ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি চেয়ারম্যান আবু ফারুক বলেন, আবাসিকে একচুলার বর্তমান দর ৯৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১,০৮০ টাকা করা হয়েছে। প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বর্তমান দর ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা, সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দর ঘনমিটার ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছে। এ দর চলতি জুন মাস থেকেই কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে সবধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে কৃষি খাতে। সার উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে যাবে। সরকার ভর্তুকি না বাড়ালে সারের দাম বেড়ে যাবে। আর এতে সরাসরি ধান, গমসহ কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যয়। তাদের মতে, বলা চলে সবধরনের পণ্যের দামই বেড়ে যাবে। তাদের মতে, গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো হলে গ্যাসের দাম বাড়াতে হতো না। আবার এ খাতের সুশাসন ও চুরি বন্ধ করা হলেও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। শুধু তাই নয়, সরকার অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমালেও গ্যাসের ভর্তুকির চাপ জনগণের ঘাড়ে পড়তো না। তাদের মতে, এমনিতেই চাল, আটা, তেলসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এরপরও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে সবধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে জনভোগান্তি।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, গ্যাস খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। সিস্টেম লসের নামে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। রয়েছে অবৈধ সংযোগ। এ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে এবং অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা হলে গ্যাসের দাম এতটা বাড়াতে হতো না। আর এর প্রভাব জনগণের ওপর পড়ত না। তিনি মনে করেন, গ্যাসের এ দাম বৃদ্ধির ফলে সবধরনের পণ্যের দামই বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যাবে। তবে, তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে কতটুকু শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে সেটা আগে দেখতে হবে। ব্যয় বাড়ানোর হারের চেয়ে পণ্যের দাম বেশি বাড়ানো হয়, তবে জনভোগান্তি বেশি বেড়ে যাবে।

গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক মো: আসাদুজ্জামান গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সারের ওপর গ্যাসের দাম ২৫৯ শতাংশ বৃদ্ধি দেশের কৃষি খাতের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ সার সরাসরি কৃষির উৎপাদনের সাথে জড়িত। এমনিতেই চাল, আটাসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এখন সার উৎপাদন ব্যয় বাড়লে ইউরিয়ার দাম বেড়ে যাবে। এতে বেড়ে যাবে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়। আর কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে চাল, তেল, আটাসহ সবধরনের কৃষিপণ্যের দামই বেড়ে যাবে। যার প্রভাব ভোক্তা শ্রেণীর ওপর পড়বে। তিনি মনে করেন, সার উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল। কারণ, গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে সার উৎপাদনে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, সরকার বাড়তি ভর্তুকি দেবে কি না, ভর্তুকি না দিলে কতটুকু বাড়ালে সহনীয় হয় সে বিষয়ে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন ছিল। তিনি মনে করেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে এ ধরনের আলোচনা করা হয়নি। বিআইডিএসের সাবেক এ গবেষণা পরিচালক মনে করেন, এখন দেখতে হবে, সারের আগের দাম ঠিক রাখা হয় কি না। যদি সারের আগের দাম ঠিক রাখা হয়, তাহলে সার উৎপাদনে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে। আর যদি সরকার ভর্তুকি আগের মতোই রাখতে চায় তাহলে সারের দাম বেড়ে যাবে।

তিনি মনে করেন, সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে সারের ব্যবহারে কৃষকের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ইউরিয়া সারের পাশাপাশি পটাশ ও ফসফেট সার সমন্বয় করে ক্ষেতে ব্যবহার করতে হবে। শুধু ইউরিয়া সার বেশি ব্যবহার করলে এটা বেশি ব্যবহার হবে, এতে বেড়ে যাবে ভর্তুকি। এ কারণে সার ব্যবহারে সমন্বয় করতে হবে। অপর দিকে দেশের ইউরিয়া সার কারখানার মেশিনগুলো অনেক পুরনো। আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলে নির্দিষ্ট পরিমাণ সার উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কমে যেত। এতে সার উৎপাদনে আর গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। তিনি মনে করেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই সরকারের ভর্তুকি বেড়ে যাচ্ছে। আর একই সাথে বাড়তে জনভোগান্তি।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ কে খান গতকাল এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেছেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। কারণ, এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, রড, সিমেন্টসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে সবধরনের পণ্যের দামই বেড়ে যাবে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে সবধরনের পণ্যের দামই বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, গত দুই বছর করোনাভাইরাসের প্রভাবে শিল্প কারখানা যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার ধকল ব্যবসায়ীরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এ কারণে আমরা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে দাম না বাড়ানোর বিষয়ে অনুরোধ করেছিলাম। বলেছিলাম, সরকারের অনুৎপাদনশীল খাতে যে ব্যয় হচ্ছে তা কমিয়ে বিদ্যুৎ গ্যাসের ভর্তুকি বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। আর তাদের অনুরোধ রাখলে বিদ্যুৎ গ্যাসের ভর্তুকির চাপ জনগণের ঘারে চাপতো না। কিন্তু তাদের অনুরোধ রাখা হয়নি। গ্যাসের দাম ঠিকই বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে মূল্যস্ফীতির চাপ। ভোগান্তি বাড়বে সাধারণের।

ক্যাবের সহসভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বরাবরের মতো গণশুনানি প্রহসনে পরিণত হলো। কোনো যুক্তি তথ্যই আমলে নেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী ৩ জুন বিইআরসিতে গিয়ে যে তামিল দিয়েছে সেটাই করেছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আদেশে বলা হয়েছে, বিদ্যুতে প্রতি ঘনমিটার ৫ দশমিক ০২ টাকা, ক্যাপটিভ ও সার কারখানায় ১৬ টাকা, শিল্পকারখানায় ১১ দশমিক ৯৮ টাকা, মাঝারি শিল্পে ১১ দশমিক ৭৮ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১০ দশমিক ৭৮ টাকা, চা শিল্পে ১১ দশমিক ৯৩ টাকা, বাণিজ্যিক ২৬ দশমিক ৬৪ টাকা, ফিড গ্যাস সিএনজি অপরিবর্তিত ৪৩ টাকা, আবাসিকের প্রিপেইড মিটার গ্রাহকদের ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/668318