৫ জুন ২০২২, রবিবার, ১১:০৬

রুয়েটে নতুন বিভাগ চালু

২৬ কোটি টাকার প্রকল্পে অর্ধেক ব্যয়ে দুর্নীতি!

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ২৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে ১৩ কোটি টাকা ব্যয় নিয়ে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সাড়ে পাঁচ বছর আগে প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও বিধি অনুযায়ী ব্যাংক হিসাব বন্ধ করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি বরাদ্দ থেকে বেঁচে যাওয়া ১৩ কোটি টাকার বেশি অর্থ। ঠিকাদারের বিল থেকে ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর হিসাবে কেটে নেওয়া এক কোটি ৩০ লাখ টাকার কোনো হদিস নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া কাজ শেষ হওয়ার পরও হিসাব থেকে টাকা উঠানো হয়েছে। এসব অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগের আঙুল উঠেছে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে। তিনি অব্যবহৃত টাকার বিষয়টি গোপন করেন। প্রাথমিকভাবে আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান। অনিয়ম দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা যাচাইয়ের জন্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইউজিসি (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন)। কমিটির সদস্যরা আজ রোববার এবং কাল সোমবার রুয়েটে সরেজমিন তদন্ত করবেন।

অভিযোগের ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ড. আবদুল আলিম কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। প্রকল্প শেষ হবার পরেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ না করা, ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন, প্রকল্পের অবশিষ্ট টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি একা কিছু করিনি। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। যদি কিছু জানার থাকে, তাহলে যারা তদন্ত করতে রুয়েটে আসছেন- তাদের প্রশ্ন করবেন বলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

জানা গেছে, রুয়েটে গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালুর বিষয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামোগত ও ল্যাবরেটরি সুবিধা’ শীর্ষক আমব্রেলা প্রকল্পের আওতায় এটা নেওয়া হয়। এর ব্যয় ধরা হয় ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালের ১ জুলাই। কাজ শেষ করার জন্য ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য পরিকল্পনা কমিশনে আবেদন করে মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। প্রকল্পের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য রূপালী ব্যাংক রুয়েট শাখায় একটি হিসাব (নং-৪৩৮, জিসিই বিভাগ) খোলা হয়।

নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ৯ আগস্ট প্রকল্প পরিচালক ও রুয়েটের তৎকালীন পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. আলীম ইউজিসিতে কাজ শেষসংক্রান্ত রিপোর্ট দেন। এতে উল্লেখ করেন, প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকা পুরোটাই ব্যয় করা হয়েছে। কোনো টাকা অবশিষ্ট নেই। এছাড়া প্রকল্পের কাজও শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ৩০ জুন (প্রকল্পের মেয়াদের শেষ দিন) অ্যাকাউন্টে ১৩ কোটি ১৫ লাখ সাত হাজার ২৭২ টাকা জমা ছিল। এরপর পরের বছর ২০১৭ সালের ১ মার্চ ছিল সাত কোটি ৫৬ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ টাকা। বিভিন্ন খাতে টাকা উত্তোলনের পর সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ জুন ওই অ্যাকাউন্টে ৫০ লাখ ৩৬ হাজার ৮৫৯ টাকা জমা ছিল। প্রকল্প শেষ হওয়ার পরেও টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

রুয়েট সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার নিয়ম। কিন্তু ওই সময়ও অ্যাকাউন্টে যে ১৩ কোটির বেশি টাকা জমা ছিল যা নয়ছয় করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এ টাকা হরিলুট করেছেন প্রকল্পের পরিচালক ড. আলীম এবং তার সহযোগীরা। এমনকি এ টাকার এআইটি এবং ভ্যাটের এক কোটি ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ টাকাও সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।

প্রকল্পের আর্থিক অনিয়ম যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গত ২০ এপ্রিল তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইউজিসি। এ কমিটির প্রধান হলেন ইউজিসির সচিব পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. ফেরদৌস জামান। এ ছাড়া সদস্যরা হলেন ইউজিসির উপপরিচালক রোকসানা এবং আরেক উপপরিচালক আবদুল আলীম।

এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, এ প্রকল্পের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে একটি অভিযোগ আসে। এরপর চেয়ারম্যানের নির্দেশে বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পে আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রকল্প পরিচালক প্রকল্প শেষ হওয়ার পরেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেননি। তিনি টাকা উত্তোলনের জন্য চেক সরবরাহ করেছেন। প্রকল্প শেষ হবার পরে অবশিষ্ট টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। এমনকি তিনি এখন পর্যন্ত অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করেননি। এটি আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি। গুরুতর অনিয়ম। বিষয়টি রোব ও সোমবার সরেজমিন তদন্ত করা হবে। এরপর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/558615