৪ জুন ২০২২, শনিবার, ১১:০৩

জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য

ঢাকায় গণপরিবহণে হয়রানির শিকার ৬৩ শতাংশ নারী

৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার * নিপীড়নকারীদের অধিকাংশই চল্লিশোর্ধ্ব * হয়রানি প্রতিরোধে ১০ দফা প্রস্তাব

রাজধানীতে গণপরিবহণে চলাচল করা কিশোরী, তরুণী ও নারীদের ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন। নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যাই বেশি (৭৫ শতাংশ)। গণপরিবহণের চালক ও চালকের সহকারীর হাতেও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সিদের সংখ্যা বেশি (প্রায় ৬২ শতাংশ)। যৌন হয়রানির শিকার এই নারীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ পরবর্তী সময় মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।

‘ঢাকা শহরে গণপরিবহণে হয়রানি : কিশোরী এবং তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শিরোনামের এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শুক্রবার ভার্চুয়াল মাধ্যমে আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই জরিপ প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. ইসমাইল হোসাইন, ঢাকা আইনজীবী সমিতির ব্যারিস্টার শাইখ মাহদি এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ। জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য ফারজানা আক্তার।

আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে গণপরিবহণে ওঠানামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে জায়গা থাকার পরও যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, ধাক্কা দেওয়া, বাজে মন্তব্য। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ নারী ঝামেলা এড়াতে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেননি। মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা আরও জানায়, জরিপ প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার বাস, ট্রেন, লেগুনা, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আজিমপুর, মিরপুর, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, বারিধারাসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী নারী ও কিছুসংখ্যক গৃহবধূর ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ৮০৫ নারী অংশ নেন। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৬ শতাংশ। জরিপ শুরুর সময়ের ছয় মাস আগ পর্যন্ত হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন এমন নারীদের তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। অফলাইন ও অনলাইনে এ জরিপ করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। জরিপটি পরিচালনা করা হয় এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানির পাশাপাশি ১৫ শতাংশ বুলিং, ১৫ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৫ শতাংশ লিঙ্গবৈষম্য এবং ৮ শতাংশ শারীরিক গঠন নিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন।

নারীদের ৭৫ শতাংশ যাত্রীর মাধ্যমে হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। ২০ শতাংশ চালকের সহকারী, ৩ শতাংশ হকার এবং ২ শতাংশ চালকের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। প্রায় ৬২ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সি ব্যক্তিদের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ৩৬ শতাংশ জানিয়েছেন, কিশোর ও যুবক অর্থাৎ ১৩ থেকে ৪৯ বছর বয়সিদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারী যাত্রী উঠানো-নামানোর সময় চালকের সহকারীদের নেমে দাঁড়ানোর কথা থাকলেও তারা বাসের দরজায় অবস্থান করে অযাচিতভাবে স্পর্শ করে বলে অভিযোগ এসেছে। প্রায় ৬১ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, ওঠানামার সময় সহকারীরা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্পর্শ করেছে। প্রায় ২৫ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, ৬ মাসে অন্তত ৩ বার তাদের এ ধরনের স্পর্শের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩১ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, গণপরিবহণে অনেক সময় ফাঁকা জায়গা থাকলেও অন্য যাত্রীরা ইচ্ছাকৃতভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ইচ্ছাকৃতভাবে হালকাভাবে স্পর্শের শিকার হয়েছেন ১৮ শতাংশ। ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কার শিকার হয়েছেন ১৪ শতাংশ। প্রায় ১৪ শতাংশ কিশোরী-তরুণী বাজে মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। হালকা ভিড়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ এবং অতিরিক্ত ভিড়ে ২৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ঝামেলা এড়াতে বেশিরভাগ নারীই প্রতিবাদ করেননি।

গণপরিবহণে হয়রানি প্রতিরোধে ১০ দফা প্রস্তাব করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে পরিবহণে আসনের বেশি যাত্রী না তোলা, গণপরিবহণের ভেতর ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, গণপরিবহণের সংখ্যা বাড়ানো, নারীদের জন্য আলাদা পরিবহণের ব্যবস্থা করা, বাসের চালক, তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারীর পরিচয় উল্লেখ করে নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া ইত্যাদি। অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, গণপরিবহণে নারী হয়রানি ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো আইনি প্রতিকার নেই। তবে দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু ধারায় এ ধরনের কিছু হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে অনেক নারী আরও হয়রানির ভয়ে বা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে ছোটাছুটি করার ঝামেলা এড়াতে প্রতিবাদ করতে সাহসী হন না। এতে করে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এজন্য তারা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, ৯৯৯ বা ১০৯-এ কল করে সাহায্য চাওয়ার পরামর্শ দেন। তারা বলেন, আইনি ব্যবস্থা নিতে কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। যেমন মুঠোফোনে ভিডিও করা বা কথা রেকর্ড করে রাখা। এসব প্রমাণ উপস্থাপন করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিচার পাওয়া যায়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/558246