৪ জুন ২০২২, শনিবার, ১০:৫৯

শুক্রবারও অভিযান

বাজারে ৫০ টাকার নিচে চাল নেই

অবৈধ মজুতের বিরুদ্ধে টানা অভিযানের পরও চালের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। বোরোর ভরা মৌসুমে মোটা চালের দাম ৫০ টাকা কেজি। অথচ এ সময় দাম কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে ৭-১০ টাকা।

শুক্রবারও খাদ্য মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসকের সমন্বয়ে যৌথ তদারকি টিম এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়েছে।

খবর পেয়ে কিছু চাল ব্যবসায়ী ভয়ে পালিয়ে গেছেন। লাগাতার অভিযানে জরিমানার পর চালের দামে কোনো প্রভাব নেই। চট্টগ্রামেও খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। তবে ভয়ে দু-এক জায়গায় দাম কিছুটা কমেছে বলে জানা গেছে।

মঙ্গলবার থেকে চালের বাজারে মজুতবিরোধী অভিযান শুরু হয়। কয়েক দিন ধরে টানা চলছে এ অভিযান। শুক্রবার সকালেও রাজধানীর রামপুরা ও মালিবাগ এলাকার বাজারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা জেলা প্রশাসকের সমন্বয় যৌথ তদারকি টিম।

পাশাপাশি মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে চালের আড়তে অভিযান পরিচালনা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রামপুরা ও মালিবাগ এলাকার বাজারগুলোতে জরিমানা না করা হলেও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে চালের আড়তে বিভিন্ন অপরাধে চারটি প্রতিষ্ঠানকে মোট এক লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে সব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা চলছে। তেল, ডাল, চিনি, আটা-ময়দার পর এবার চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। এতে নিম্ন আয় ও খেটে খাওয়া মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন-সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে চালের দাম কমাতে অভিযান পরিচালনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে বেশি তদারকির চিত্র দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম। খোদ খাদ্যমন্ত্রীর ভাষ্য, গুটিকয়েক করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কারণে চালের দাম বেড়েছে। কিন্তু সেখানে তদারকি নেই। তারা বোরো ধানের বড় অংশ কৃষকের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে।

এরপর ধান থেকে চাল করে বেশি দামে বাজারে ছাড়ার জন্য গুদামে মজুত রেখেছে। ফলে মিলারদের কাছে পর্যাপ্ত ধান নেই। তাই পাইকারি বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ আসছে না। এতে খুচরা বাজারে চালের সংকট ও দাম দু-ই বাড়ছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, চালের দাম কমাতে সব পর্যায়ে তদারকি জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে যারা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিদ্যমান আইন প্রয়োগ করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

শুক্রবার রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে-প্রতি কেজি মিনিকেট ৬৬-৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা এক মাস আগে ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

নাজিরশাইল চাল কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৮০-৮২ টাকা। এক মাস আগে ৭০-৭২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি বিআর ২৮ জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৫৫-৫৮ টাকা। যা আগে ৫০ টাকা ছিল।

এছাড়া মোটা চালের মধ্যে প্রতি কেজি স্বর্ণা জাতের চাল বিক্রি হয়েছে ৫০-৫২ টাকা, যা এক মাস আগে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সরেজমিন দেখা যাচ্ছে, প্রতি কেজি চাল কিনতে একজন ক্রেতার সর্বনিম্ন ৫০ টাকা গুনতে হচ্ছে।

রাজধানীর কাওরান বাজারে চাল কিনতে আসা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. কাদের ক্ষোভ নিয়ে যুগান্তরকে বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তি। এবার চাল কিনতেও বাড়তি টাকা ব্যয় হচ্ছে।

আগে যে মিনিকেট ৬২ টাকায় কিনতাম এখন ৭০ টাকা গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, মাস শেষে আমি বেতন পাই ৩৫ হাজার টাকা। বাজারেই আমার বেতনের বড় অংশ খরচ হচ্ছে।

বাকি টাকা দিয়ে ঘরভাড়া, সন্তানদের পড়ালেখাসহ অন্যান্য খরচ বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। নয়াবাজারে কথা হয় ভ্যানচালক মো. মকবুলের সঙ্গে।

তিনি যুগান্তরকে বলেন, সব পণ্যের দাম বাড়ার কারণে কিছুদিন ধরে আলু ভর্তা ও ডিম দিয়ে ভাত খাওয়া হতো। এখন চালের দাম বাড়ায় আমি চিন্তিত। ৫০ টাকার নিচে চাল নেই। আমরা গরিব মানুষ, কিভাবে দিন এনে দিন খাব তা বুঝতে পারছি না।

মালিবাগ কাঁচাবাজারের খালেক রাইস এজেন্সির মালিক ও খুচরা চাল বিক্রেতা মো. দিদার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, চালের দাম কমছে না। বরং মিল থেকে নতুন করে বাড়তি দাম ধরে দিয়েছে।

এখন দোকানে যে চাল আছে সেগুলো বিক্রির পর নতুন দরের চাল আনতে হবে। বিক্রিও করতে হবে বেশি দামে। তিনি বলেন, সরকারের তদারকি টিম বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে।

তারা মূল্য তালিকা না দেখলে জরিমানা করছে। কেনা দামের তুলনায় ৪-৫ টাকা বেশি বিক্রি করলে শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু যে বা যারা চালের বাজার অস্থির করল তাদের ধরছে না।

যারা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের কেউ আইনের আওতায় আনছে না। তাদেরকেই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সবপর্যায়ে তদারকি চলছে। তবে পাইকারি ও খুচরা বাজারে তদারকি দৃশ্যমান।

অন্যান্য স্থানে তথ্য সংগ্রহ চলছে। অভিযানও পরিচালনা করা হবে। দাম বাড়ানোর পেছনে যারা জড়িত তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে অনেক অসাধু ব্যবসায়ীকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।

রাজধানীতে অভিযান : শুক্রবার অবৈধ মজুতদারের বিরুদ্ধে রাজধানীর বেশ কিছু জায়গায় অভিযান পরিচালনা করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা জেলা প্রশাসকের যৌথ তদারকি টিম।

পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একটি টিম তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করে। সকালে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে চালের আড়তে অভিযান পরিচালনা করেন ভোক্তা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস।

এ সময় অভিযানের খবর পেয়ে বাজারের কিছু চাল ব্যবসায়ী পালিয়ে যান। তদারকিকালে বিভিন্ন অপরাধে চারটি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এদের মধ্যে আনোয়ার ট্রেডার্সকে ৫০ হাজার, মদিনা রাইস এজেন্সিকে ৫০ হাজার, সততা ট্রেডার্সকে ৫০ হাজার ও সাইকা রাইস এজেন্সি নামের প্রতিষ্ঠানকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

পাশাপাশি এ দিন অবৈধ মজুতদারের বিরুদ্ধে রাজধানীর রামপুরা ও মালিবাগ এলাকার বাজারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা জেলা প্রশাসকের যৌথ তদারকি টিম। তদারকির নেতৃত্ব দেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মর্জিনা আক্তার। এ সময় কোনো ধরনের জরিমানা করা হয়নি।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে চালের অসাধু ব্যবসায়ী ও মিলারদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন ও খাদ্য বিভাগের অভিযানের পরও খুচরা বাজারে কমছে না দাম।

খুচরা পর্যায়ে বা উপজেলা পর্যায়ে চালের দাম এখনও বাড়তির দিকে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে চালের বৃহৎ মোকাম পাহাড়তলী ও খাতুনগঞ্জে দাম কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে এসেছে।

কিছু স্থানে বস্তায় সর্বোচ্চ ২০০ টাকা কমেছে। তবে কিছু কিছু মিলার এখনও চাল মজুত করে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

পাহাড়তলী ও চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, অসাধু ব্যবসায়ী যারা চালের ডিও (ডিমান্ড অর্ডার) কিনে চাল মজুত করে রাখতেন, তারা এখন মোবাইল কোর্টের ভয়ে তটস্থ।

তারা ডিও কেনা বন্ধ রেখেছেন। তবে কিছু মিলার চাল নিয়ে এখনও চালবাজি করছেন। তারা বিপুল পরিমাণ চাল মজুত করে রাখছেন। যাতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। অন্যদিকে চালের চাহিদা বাড়ার কারণে দামও বাড়ছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/558239