৪ জুন ২০২২, শনিবার, ১০:৫৫

চাল নিয়ে চালবাজিতে জড়িত কর্পোরেট সিণ্ডিকেট

চট্টগ্রামে প্রতিদিন বাড়ছে চালের দাম। ভরা মৌসুমে অন্যান্য বছর চালের দাম কমলেও এ বছর দাম বাড়ছেই। দাম কোনোভাবে কমানো যাচ্ছে না। সিণ্ডিকেট কারসাজিতে বাড়ছে চালের দাম। কখনও পেঁয়াজ, কখনও তেল, কখনো ময়দা, কখনও বা চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভরা মৌসুমেও দেশে চালের দাম বেশি হওয়ার কারণ খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন চালবাজার ও গুদামে অভিযান চালালেও সিণ্ডিকেট সদস্যরা রয়েছে বহাল তবিয়তে। ফলে চালের মূল্যবৃদ্ধির রোধ করা যাচ্ছে না।

নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এখন কর্পোরেট সিণ্ডিকেট এর হাতে চলে গেছে। তেলের পর এবার তারা কোটি কোটি টাকার চাল কিনে মজুদ করছে। ফলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে চালের দাম! হাতেগোনা কয়েকটি কর্পোরেট গ্রুপ। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার ব্যবস্থা। সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে মজুদ সি-িকেট এর দহরম-মহরম সর্ম্পক রয়েছে। ফলে মজুদ সিণ্ডিকেট এর বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তাদের গুদামগুলোতে অভিযান চলে না!

কয়েক মাস ধরে দেশে ভোগ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় যেখানে নাভিশ্বাস উঠেছে। সেখান নতুন করে চালের দাম বাড়ায় ক্রেতাদের এখন ত্রাহি অবস্থা। মোটা চাল ও মোটামুটি ভালো মানের চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। এতে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কষ্ট আরেক দফা বেড়েছে। তারা হয়ে পড়েছেন দিশেহারা।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, কর্পোরেট গ্রুপগুলো পাইকারি ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। তাদের দিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে পরবর্তীতে কোটি কোটি হাতিয়ে নেয়। সম্প্রতি চালের মূল্যবৃদ্ধির বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

তাদের অনুসন্ধানে বেশ কয়েকজন পাইকারি ব্যবসায়ীর কারসাজি বিষয়টি বেরিয়ে আসে। চট্টগ্রামে সি-িকেট কারসাজিতে রয়েছে চাক্তাই এলাকার বেশ কিছু পাইকারি চাল ব্যবসায়ী। তারা হলেন-মহিউদ্দিন বেলাল, মাহামুদুল হক, মোহাম্মদ রাসেল, মোহাম্মদ হান্নান ও নাছির উদ্দীন। বৃহস্পতিবার অভিযানে নাছিরের দোকান সিলগালা করা হয়। অন্যরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।

উল্লেখ্য, চাক্তাই এলাকায় প্রায় তিনশ’ চালের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে পাইকারিতে চাল সরবরাহ করে উল্লেখিত সিন্ডিকেট। চাক্তাই পাইকারি চাল ব্যবসা কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা সিন্ডিকেট করে চালের বাজার কামাচ্ছে ও বাড়াচ্ছে। তাদের হাতে জিম্মি তিনশ’ দোকানদার। অনেকে শুধু চাল ব্যবসার কমিশন এজেন্টে হয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি বস্তা চালে (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত চাল রপ্তানি সীমিত করবে-এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে চট্টগ্রামে পাইকাররা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে অসাধু ও বড় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার আশায় শতশত বস্তা চাল মজুদ করছেন। এ কারণে বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের কিছু বড় ব্যবসায়ী আছেন যাদের চালের মিল নেই। কিন্তু তারা প্যাকেটজাত চাল বিক্রি করেন। চাল প্যাকেটজাত করার জন্য এসব ব্যবসায়ী চাল মজুদ করছেন। এছাড়া বেসরকারি আমদানিকারকরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আবার আড়তদাররা আগের দরে চাল বিক্রি করছেন না। এ কারণে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী।

পাইকারিতে জিরাশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা ৩৫০০ টাকা দরে। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তা বিক্রি হয়েছিল ২৮০০ থেকে ২৯০০ টাকা। ওই চাল খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৬৫০ টাকা বা এরও বেশি দরে। নূরজাহান সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ২২৫০-২৩০০ টাকা দরে। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তা বিক্রি হয়েছিল ১৮০০ থেকে ১৮৫০ টাকা দরে।

পাইকারি বাজারে মিনিকেট আতপচাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ২৭০০-২৭৫০ টাকা দরে। কয়েকদিন আগেই তা বিক্রি হয়েছিল ২৪৫০-২৫০০ টাকা দরে। পাইকারি বাজারে মিনিকেট সিদ্ধ বিক্রি হচ্ছে ২৮০০-২৮৫০ টাকায়। খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে আরও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা অতিরিক্ত দামে। এ চালের দাম দুই সপ্তাহ আগে ছিল বস্তা ২৪০০-২৩৫০ টাকা। মোটা আতপ বিক্রি হচ্ছে ১৮০০-১৯০০ টাকা দরে।

আগে বিক্রি হয়েছে ১৫০০-১৫৫০ টাকা দরে। মোটা আতপ পুরান বিক্রি হচ্ছে ২২০০-২২৫০ টাকা। আগে বিক্রি হয়েছে ১৮০০-১৮৫০ টাকা দরে।

গুটিসিদ্ধ বিক্রি হচ্ছে ২১০০-২১৫০০ টাকায়। যা আগে বিক্রি হয়েছে ১৭০০-১৭৫০ টাকা। মোটা সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ২১০০ টাকায়। কয়েকদিন আগে বিক্রি হয়েছে ১৯০০ টাকায়। চিনিগুড়া চাল প্রকারভেদে ৫শত টাকা বাড়িয়ে প্রতি বস্তা ৫ হাজার টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরীর চাক্তাই চালের আড়ত ও বন্দর মার্কেটে বড় অভিযান পরিচালনা করেছে জেলা প্রশাসন। অন্যায়ভাবে চালের মূল্য বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত মজুদের দায়ে ৬ আড়তদারকে জরিমানা ও একটিতে সিলগালা করা হয়। আড়তগুলো হচ্ছে-এস এ ট্রেডার্স ও সাদ এন্টারপ্রাইজ, বাগদাদ রাইচ এজেন্সী, বন্দর মার্কেট এলাকার গরীবে নেওয়াজ এন্টারপ্রাইজ, হাশেম ব্রাদার্স ও মেসাস হাজী অহিদুর রহমান। এছাড়া আল্লাহর দান চাউল ভান্ডার নামে এক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার পাশাপাশি সীলগালা করে দেয়া হয়।

এর আগেরদিন নগরীর পাহাড়তলী চাল বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত মজুত করার অভিযোগে চার আড়তদারকে জরিমানা ও এক আড়ত সিলগালা করে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। আড়তগুলো হল-মেসার্স বাগদাদ ট্রেডিং, মেসার্স শাহজালাল স্টোর, বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স ও মেসার্স রাইচ হাউজ। এসময় ফুড গ্রেইন লাইসেন্স না থাকায় আমেনা ট্রেডার্সকে সিলগালা করা হয়।

জানতে চাইলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চালের দাম বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত চাল মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করছে। বিষয়টি নজরে আসার পর আমরা অভিযানে যায়। দেখা গেছে, চাল মজুদ করার লাইসেন্সে উল্লখিত পরিমাণের বাইরে চাল মজুদ করছিল ব্যবসায়ীরা। যার কারণে তাদের জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি মুচলেকা নেয়া হয়েছে।

https://dailysangram.com/post/491205