৪ জুন ২০২২, শনিবার, ১০:৫৩

নারী নির্যাতনের রুট বন্ধ করতে হবে

-মো. তোফাজ্জল বিন আমীন

নারী নির্যাতন একটি সামাজিক সমস্যা। নারীর ওপর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন বেড়েই চলছে। পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই এ ধরনের খবর চোখে পড়ে। নারী ঘরে-বাইরে-কর্মক্ষেত্রে কোথাও নিরাপদ নয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে নারী নির্যাতনের হারে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে, যা সত্যিই উদ্বেগজনক। নারী নির্যাতন আমাদের অগ্রগতি ও সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। নারী নির্যাতন বলতে সাধারণত আমরা বুঝি কাউকে শারীরিকভাবে আঘাত, অপদস্থ করা। ব্যাপারটি কিন্তু আসলে তা নয়। নারী নির্যাতনের ব্যাপ্তিটা অনেক বড়। এটা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিকভাবেও হতে পারে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শালিসের নামে নির্যাতন করার ঘটনা প্রায়ই আমরা খবরের কাগজে দেখি। কখনো মাথার চুল, কখনো চুনকালি মেখে, কখনো গাছের সঙ্গে বেঁধে, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নারী নির্যাতন করা হয়। এ নিয়ে মামলা হয়। কিন্তু ভুক্তভোগী নারী বিচার পায় না। এছাড়াও অনলাইনে ইদানিং নির্যাতন বেড়েছে। অনলাইনে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা, কথোপকথনের রেকর্ড করা ও অশালীন প্রস্তাব দেয়াও নির্যাতনের আরেকরূপ। এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করলে ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণও দিতে হয়। এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির খুবই কম হওয়ায় দিন দিন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে।

বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান জাতীয় মহিলা পরিষদ, বিবিএস এবং আইন ও শালিসকেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত নারী নির্যাতনের কিছু ঘটনা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রকাশ করেছেন। জাতীয় মহিলা পরিষদ ২০১৩ সালে ৪,৭৭৭ জন নারী নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে ৮১২ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান আরো মারাত্মক। তাদের ভাষ্যমতে বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় একজন করে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাহলে বছরে কত দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয়! এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। জাতীয় মহিলা আইনজীবী পরিষদ এবং অন্যান্য সংস্থার ভাষ্যমতে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৫০টির মতো নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে গেল বছরে পারিবারিক সহিংসতা হয়েছে ৩৯৪টি। স্বামীর হাতে নিহত হয়েছেন ১৯১ জন। আর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭২৪ জন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ৬৫ জন নারী। গত ২৭ অক্টোবর ‘উইমেন সাপোর্ট ও ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন’ তেজগাঁও থানা কমপ্লেক্সে হটলাইন নম্বর উদ্বোধন করে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা অপরাধ বিশ্লেষণ করে দেখেছি গত ১০-১৫ বছরে নারী নির্যাতনের ঘটনা অনেকাংশে বেড়েছে। কিন্তু এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা ওইভাবে লক্ষ্য করি না। দুই মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ হলেও সেই মামলার বিচার প্রক্রিয়া ২ বছর এমনকি ২৫ বছরেও চলে যায়। এতে যেমন আমাদের হাত থাকে না। ঠিক আদালতের হাতেও সব বিষয় থাকে না। সাক্ষী পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়।’ এটা আমাদের জন্য অবশ্যই দুশ্চিন্তার বিষয়। এটি দেশ ও জাতির জন্য একটি কলংকজনক অধ্যায়।

নারী নির্যাতন ঠেকানোর জন্য চেষ্টা করেও থামানো যাচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২০ সালে নারী নির্যাতন ও প্রতিরোধ আইনের সঠিক প্রয়োগের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কঠোর শাস্তি অজামিনযোগ্য অপরাধের বিধান রয়েছে। কিন্তু তাতেও কমছে না। আর একটা পরিসংখ্যান প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে বিবাহিত নারীরা প্রায় ৭০ শতাংশ স্বামী দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছেন। এর বাইরেও অবিবাহিত নারীরা নিয়োগকর্তা কিংবা সহকর্মীদের দ্বারা, সমাজের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন। এটা বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র। নারী এবং পুরুষের সমান অধিকার। নারীর উপর পুরুষের যেমন অধিকার রয়েছে তেমনিভাবে পুরুষের উপরও নারীর অধিকার রয়েছে। এই মৌলিক কথা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত, অনুসরণ করার জন্য দেয়া। আমরা যদি সৃষ্টিকর্তার কথাগুলো সামনে রাখি তাহলে নির্যাতন অনেকাংশে কমে যাবে। এই প্রবণতা ঠেকাতে হবে। এটা আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। রাষ্ট্র আইন করে রেখে দিয়েছেন। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাণদ-ের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রাণদ- কার্যকর হওয়ার পদ্ধতি অনেক লম্বা। সুতরাং এই লম্বা পদ্ধতির কথা অনুসরণ করে নিগৃহীতা নারী আইনের আশ্রয় কিংবা অভিযোগ নিতে ভয় পায়। কারণ তাদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। সুতরাং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারলে এই নির্যাতন থামবে না।

নারীর অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই নারীকে সমাজের চোখে অপরাধী হিসেবে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়। তাদের অপরাধ তাদেরকেই প্রমাণ করতে হয়। এটা হলো একটা অদ্ভুত ব্যাপার। অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা যায় যিনি অপরাধী তিনি নিজেকে নিরপরাধ করার জন্য প্রমাণ যোগাড় করেন। কিন্তু এখানে উল্টোটা। যিনি নিগৃহীত হয়েছেন তাকে প্রমাণ করতে হয় তিনি নির্দোষ। এই আইনের এই ব্যত্যয় নির্যাতনের ঘটনাকে উসকে দিচ্ছে। আইনের ব্যত্যয় এখন ওপেন সিক্রেট। ক্ষমতার দাপট ও অর্থের ক্ষমতার কাছে কখনো কখনো আইন মাথা নিচু করে ফেলে। এরকম ঘটনারও নজির আছে। এছাড়া রাজনৈতিক কারণে অপরাধীরা অন্যায় করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। এই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে নারীরাও মানুষ। তারা এই সমাজটাকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অকল্পনীয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ইতিহাস এ সাক্ষ্য দেয়। আরব ইতিহাসের কিংবদন্তি নারী রানি বিলকিসের কথা আমরা জানি। পবিত্র কুরআনের সূরা নামলে (২৯-৩৬ আয়াত) রানি বিলকিসের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকের একজন। ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক সুলতানা রাজিয়া এবং মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথা আমরা জানি। এছাড়াও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক, ভারতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারা কিন্তু দেশ সমাজ এবং জাতিকে তাদের কর্মদক্ষতা এবং বিচক্ষণতা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সুতরাং এ জায়গাটাতে আমাদের নারীদের বিচক্ষণতা এবং কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি দিতে হবে। কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত উক্তিটি আমাদের মনে রাখতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। এই চিরসত্যটা আমাদের মেনে নিতে হবে, স্বীকার করতে হবে। মানসিকভাবে এটি লালন করতে হবে। এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে কেবল নারীর মর্যাদা, ক্ষমতায়ন বাস্তবরূপ লাভ করবে। শুধু আইনে করে এ নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। আশা করি এব্যাপারে সংশ্লিষ্টমহল উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবেন।

https://dailysangram.com/post/491183