৩ জুন ২০২২, শুক্রবার, ১০:৫১

দ্রব্যমূল্যের নিত্য ঘায়ে বিপর্যস্ত জনজীবন

বাজার পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। কোনোভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। শুধু খাদ্যপণ্য নয়, মানুষের প্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের দাম বাড়তি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে নীতিসহায়তা, অসাধু তৎপরতা রোধে অভিযান, শুল্ক্ক ছাড়- এমন সব উদ্যোগ কাজে আসছে না। চাল, আটা, ডাল, ভোজ্যতেল, ডিম, দুধ, শাকসবজিসহ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়ছেই। এ পরিস্থিতিতে দৈনন্দিন ব্যয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না দরিদ্র, সমস্যাগ্রস্ত, নিম্ন আয় ও সীমিত আয়ের মানুষ।

চাল আমদানিতে আগে থেকেই শুল্ক্ক ছাড় রয়েছে। বন্দর থেকে দ্রুত পণ্য খালাসে উদ্যোগ নিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধসহ অন্যান্য আইনি সহায়তা দিতে কাজ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থা। ভোজ্যতেলের বাজারে স্থিতিশীলতা রাখার জন্য সরকার আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। এমনকি টিসিবি ও খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরবরাহ বাড়িয়েছে সরকার। টিসিবি ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে সয়াবিন তেল, ডাল ও চিনি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ১৫ জুন থেকে সরবরাহ করা হবে। বাড়ানো হয়েছে চাল ও আটার খোলাবাজারে বিক্রি কার্যক্রম।

এসবের পাশাপাশি বাজারে চালানো হচ্ছে অভিযান। পণ্য জব্দ, জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু এসব উদ্যোগের কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। পণ্যমূল্য বেড়েই চলেছে।

বিশ্নেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারের প্রভাব দেশের বাজারে আছে ঠিকই, কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পরিস্থিতির সুযোগও নিচ্ছেন। পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তো রয়েছেই। যেসব পণ্যের দাম বাড়ার যৌক্তিকতা নেই, সেগুলোরও দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেকে পণ্য মজুত করে বাড়তি দাম হাতিয়ে নিচ্ছেন। এজন্য তাঁরা বাজারে মনিটরিং জোরদার করা এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির সুপারিশ করেছেন।

করোনা-পরবর্তী আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ওই দুটি দেশসহ অন্যান্য অনেক দেশ থেকে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলেও দেশে দেশে পণ্যমূল্য বেড়েছে। সবশেষে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বাড়তি চাহিদার কারণে বেড়েছে পরিবহন খরচ। দেশে দেশে যার প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব পণ্যে আমদানিনির্ভরতা নেই সেগুলোরও দাম বাড়ছে। বিশেষ করে চাল। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের প্রধান খাদ্যটির দাম মান ও জাতভেদে কেজিতে ৩ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বোরোর ভরা মৌসুমে চালের দাম বৃদ্ধি মানুষকে আরও বিপাকে ফেলেছে। অন্যদিকে বড় ব্যবসায়ীদের গুদামে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত মজুত পাওয়া যাচ্ছে।

এ ছাড়া এক মাসের ব্যবধানে আটার দাম বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এতে আটা ও ময়দা থেকে তৈরি পণ্যের দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা; কিন্তু বাস্তবে বেড়েছে আরও বেশি। প্রতিটি ডিম খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১১ টাকা দরে।
গতকাল রাষ্ট্রীয় সংস্থা মিল্ক্ক ভিটা দুধসহ তাদের সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি তরল দুধের দাম লিটারে ৫ টাকা বাড়িয়েছে। আগে থেকেই বেসরকারি কোম্পানির দুধের দাম বেড়ে আছে। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে সয়াবিন ও পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে। ডালের দামও রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে অ্যাঙ্কর ডালের দাম কেজিতে ৭ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বেড়েছে অন্যান্য ডালের দামও। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনো মরিচ, হলুদসহ বিভিন্ন মসলার দামও বেড়েছে। বেড়েছে শাকসবজির দামও। বাজারে অধিকাংশ সবজির কেজিপ্রতি দাম ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত এপ্রিলে গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি হয়েছে। সাধারণ মূল্যস্ম্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ম্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, মে মাসে মূল্যস্ম্ফীতি আরও বেড়েছে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে মূল্যস্ম্ফীতির হার আরও বেশি বলে বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

রাজধানীর কাকরাইলের একটি গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্মী শরিফুল ইসলাম বাবু জানান, দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক খরচ এখন আর তিনি করতে পারছেন না। উদাহরণ দিয়ে বলেন, তিন মাস আগেও অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার সময় বাচ্চাদের জন্য চকলেট, আইসক্রিম বা অন্য কিছু কিনে নিয়ে যেতেন। এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, নিত্যদিনের খাবার বাবদ তার ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কয়েক মাস আগে সারা মাসের বাজার করতে ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা লাগত। এখন তা ১০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা তাঁর বাসা ভাড়ার সমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষণা সংস্থা সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা সমকালকে বলেন, দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সমস্যা রয়েছে। গত কয়েক বছরে কয়েকবার পেঁয়াজের বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা গেছে। চালের বাজারের অস্থিতিশীলতা বেশ পুরোনো। সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও এগুলোর সমাধান হচ্ছে না। এর অর্থ হচ্ছে, বাজারের সমস্যা সমাধানে এডহক ভিত্তিতে স্বল্প সময়ের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী কর্মসূচি নিতে হবে। তিনি বলেন, বাজারে স্থিতিশীলতার জন্য মনিটরিং জোরদার করতে হবে। বাজারের অস্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আমদানি, সরবরাহ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে। এসব কিছু করার জন্য তিনি একটি শক্তিশালী কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন। তিনি আরও বলেন, চাল, গমের দাম বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়ে যান। কারণ সাধারণ মানুষের মোট ব্যয়ের বড় অংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় হয়।

এদিকে পাড়া-মহল্লার কয়েকজন দোকানদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক পণ্যের বিক্রি কমেছে। বিশেষ করে মোড়কজাত খাবারের। আর যেসব মোড়কজাত খাবার বিক্রি হচ্ছে সেগুলো ছোট সাইজের। চানাচুর, চিপস, বিস্কুটের মতো পণ্যের বেচাকেনা বেশ কমেছে। কমেছে কোমল পানীয়, প্রসাধনী পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের বিক্রি।

https://samakal.com/bangladesh/article/2206114644