৩ জুন ২০২২, শুক্রবার, ১০:৪০

এক দিনে ডলারের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি

একক দর থেকে সরে এলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। গতকাল আমদানি পর্যায়ে (বিসি সেলিং) ডলারের দাম সর্বনিম্ন ১ টাকা ৭৫ পয়সা ও সর্বোচ্চ ২ টাকা ৩৫ পয়সা বাড়িয়ে ৯০ টাকা ৯০ পয়সা ও ৯১ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর আন্তঃব্যাংকে ১ টাকা বাড়িয়ে ৮৯ টাকা থেকে ৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে এক সাথে টাকার এতটা অবমূল্যায়ন করা হয়নি। একই সাথে ব্যাংকে গতকাল ক্যাশ ডলার বিক্রি হয়েছে ৯৩ টাকা থেকে ৯৭ টাকা দরে। তিন দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের একক দর নির্ধারণ করা থেকে সরে আসায় ব্যাংকগুলো গতকাল নতুন এ দর নির্ধারণ করে লেনদেন করে। আর ব্যাংকগুলো এ তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো আবারো বাজারভিত্তিক ডলার দর নির্ধারণের সুযোগ পেলো।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া একক দর কার্যকর হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে বাজারে ডলারের ক্রেতা আছে তো বিক্রেতা নেই। আবার এ বেঁধে দেয়া দরে রেমিট্যান্সও কমে গেছে। সবমিলেই ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে গত বুধবার পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের প্রস্তাবটি বিবেচনায় নিয়েই একক দর নির্ধারণ থেকে সরে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো এ অবাধ সুযোগের অপব্যবহার না করে সে জন্য বাজার তদারকি অব্যাহত রাখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে ব্যাংকগুলো কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করতে তাদের হাতে বাড়তি ডলার মজুদ রাখছে কি না সেটি যাচাই করা হবে। এ জন্য প্রতিদিনের এনওপির (ব্যাংকগুলোর ডলার রাখার সীমা) অবস্থান, আমদানি পর্যায়ে ডলারের মূল্য এবং কী দামে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে তার তথ্য বেলা ১১টার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সিদ্ধান্ত নেয়ার তিন দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক হঠাৎ করে তার অবস্থান থেকে সরে আসার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডলারের একক দর ব্যাংকগুলো নির্ধারণ করার পর রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়েছে এমন দাবি করা হয়েছিল অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে। গত মে মাসের প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোর দাবি সত্যি হয়েছে। এতে রিজার্ভ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়। আর এ কারণেই তিন দিনের মাথায় আমরা সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। আর ডলারের মূল্য নির্ধারণের সীমা তুলে দেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

তিথিন বলেন, বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ (এবিবি) ডলাথরের একটি রেট প্রস্তাব করেছিল। সেটা ধথরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ব্যাংগুলো বেঁধে দেয়া রেটের কারণে বিদেশ থেকে তেমন একটা রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারছে না। এসব বিষয় আমলে নিয়ে আমরা ব্যাংকগুলোথকে নির্দেশ দিয়েছি, তোমরা কত রেট দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করবে তা তোমরাই নির্ধারণ করো। অর্থাৎ ব্যাংকগুথলো প্রতিযোগিতামূলক দর নির্ধারণ করবে আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি তদারকি করথবে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরেই ডলার সঙ্কট চলছে। বিশেষ করে গত মার্চ থেকে ডলার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। টাকার মান ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করতে থাকে। কিন্তু গত এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়নে নেমে যায়। আগে যেখানে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়। বিপরীতে গত দুই বছর বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য পরিশোধ না করে বাকি রাখা হয়, যা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে যাওয়ায় পরিশোধ শুরু হয়। একই সাথে পণ্য আমদানি বেড়ে যায়। সবমিলেই ডলারের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ডলারের মূল্যের ওপর।

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এসে ডলারের খোলাবাজারের মূল্য সেঞ্চুরি অতিক্রম করে ১০৩ টাকা হয়। আর ব্যাংকে ক্যাশ ডলার ৯৮ টাকায় উঠে যায়। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যেতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলারের একক দর বেঁধে দেয়া হয়। বলা হয়, আন্তঃব্যাংকে ৮৯ টাকা এবং আমদানিতে ৮৯ টাকা ১৫ পয়সার বেশি ডলার লেনদেন করা যাবে না।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দর আসলে কোনো সময়ে কার্যকর হয়নি। ব্যাংকগুলোতে একদিকে ডলার সরবরাহ কমতে থাকে। বিপরীতে চাহিদা বাড়তে থাকায় ব্যাংকগুলোর আন্তঃব্যাংকের ডলারের বাজার বিক্রেতা শূন্য হয়ে পড়ে। বাজারে শুধু ক্রেতা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংক ডলারের অভাবে আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে গত বুধবার ব্যাংকাররা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে। এতে মে মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এপ্রিল মাসে যেখানে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০১ কোটি ডলার, মে মাসে তা কমে হয় ১৮৮ কোটি ডলার। অথচ রেমিট্যান্স বাড়াতে নীতিমালা শিথিল করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। আগে ৫০ হাজার ডলার বা পাঁচ লাখ টাকার অতিরিক্ত রেমিট্যান্স আনতে হলে বৈধ কাগজপত্র দেখাতে হতো। এখন তা তুলে দিয়ে বলা হয়, যতখুশি তত রেমিট্যান্স আনা যাবে, কোনো কাগজপত্র জমা দিতে হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করেই ডলারের একক দর তুলে দেয়া হয়েছে। গতকাল এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত দেয়ার পরেই ব্যাংকগুলো রেকর্ড পরিমাণ ডলারের মূল্য বাড়িয়েছে। গতকাল আমদানি পর্যায়ে সরকারি ব্যাংকগুলো ৯০ টাকা ৯০ পয়সা, আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৯১ টাকা ৫০ পয়সা দরে লেনদেন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আগে এদের ছিল ৮৯ টাকা ১৫ পয়সা। অপর দিকে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন করা হয়েছে ৯০ টাকা। তবে কিছু ব্যাংকার জানিয়েছেন, যেসব ব্যাংকের ডলার সঙ্কট বেশি ছিল তারা এর চেয়েও বেশি দরে লেনদেন করেছে।

একটি ব্যাংকের ট্রেজারি হেড জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহজুড়েই ডলারের দাম বাড়তে পারে। কারণ ডলারের সরবরাহ কমে গেছে। কিন্তু চাহিদা কমেনি, বরং বেড়ে গেছে। এ কারণে আগামী সপ্তাহজুড়েই ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। বেশি দাম পাওয়ার আশায় প্রবাসীরা বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠাবেন। এতে আপনা আপনিই ডলারের সরবরাহ বেড়ে গিয়ে মূল্য স্থিতিশীল হবে।

এ দিকে ডলারের মূল্য বেশি বেড়ে গেলে পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বিলাসজাত পণ্য আমদানি কমানোর ওপর জোর না দিলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ আরো বেড়ে যেতে পারে। আর এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাজার তদারকিতে জোর দেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/667656