৩ জুন ২০২২, শুক্রবার, ১০:৩৮

রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ভাটা ॥ বাণিজ্য ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে দেখা দিয়েছে ভাটার টান। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগের পরও হঠাৎ করেই কমে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। বাজারে যখন ডলারের সংকট চলছে, হু হু করে বাড়ছে দাম, ঠিক তখন ‘অশনি’ বার্তা দিল প্রবাসী আয়। রেমিটেন্সের পর এবার কমল রপ্তানি আয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গত মে মাসে বিশ্ববাজারে ৩৮৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের গত ৯ মাসের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন। এদিকে রফতানির তুলনায় আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার। যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।

রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগের পরও হঠাৎ করেই কমে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মে মাসে দেশে ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ৮৯ টাকা ধরে) এই অর্থের পরিমাণ ১৬ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এ অঙ্ক আগের মাসের চেয়ে প্রায় ১২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার কম। এপ্রিলে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০১ কোটি ৮ লাখ ডলার। আর আগের বছরের মে মাসের তুলনায় এবার ২৮ কোটি ৫৭ লাখ ডলার কম এসেছে।

গত বছর মে মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিল ২১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। সর্বশেষ গত ২৩ মে যত খুশি তত রেমিট্যান্স পাঠানোর পথ সহজ করে দিয়ে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সে অনুযায়ী এখন পাঁচ হাজার ডলারের ওপরে বা ৫ লাখ টাকার বেশি রেমিট্যান্স এলেও কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই প্রণোদনা পাচ্ছেন প্রবাসীরা। এরপরও কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।

এদিকে ডলার সংকটের এ সময়ে রেমিটেন্সের পর এবার কমেছে রপ্তানি আয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গত মে মাসে বিশ্ববাজারে ৩৮৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের গত ৯ মাসের মধ্যে এটিই সর্বনি¤œ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ইপিবির তথ্য মতে, মে মাসে বিশ্ববাজারে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৮৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৮৩ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের (জুলাই-জুন) গত নয় মাসে পণ্য রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭১৭ কোটি ৪৬ লাখ ৩ হাজার ডলার। গত বছরের আগস্টে রপ্তানি আয় ছিল ৩৩৮ কোটি ৩০ ডলার। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতি মাসেই ৪০০ কোটি ডলারের বেশির রপ্তানি আয় হয়। ৩৮৩ কোটি ডলারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে পোশাক খাতে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মে মাসে সামগ্রিক ৩৮ দশমকি ৫২ বিলিয়ন ডলারের আরএমজি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২৮ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে নিটওয়্যারের রপ্তানি ছিল ২০ দশমকি ৯৯ বিলিয়ন ডলার। আর তৈরি পোশাকে ১৭ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সারাবিশ্বে সংকটের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্যদের তুলনায় ভালো গতিতে এগিয়েছে। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলেও বুঝতে পারবেন, আমরা ভালো আছি। কেউ যদি ভালো সময়ের সঙ্গে এই সময় মিলানোর চেষ্টা করে, তাহলে মিলানো যাবে না। এটা যদি একই রকম না হয় তাহলে কার সঙ্গে কার কম্পেয়ার (তুলনা) করবেন? অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেট নিয়ে আমরা কোনো চাপ বোধ করছি না। আমরা যুদ্ধ (রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ) নিয়ে চাপ বোধ করছি। আমরা চাই যুদ্ধটি শেষ হোক। কোভিড শেষ করলাম, কোভিড যা ক্ষতি করার করেছে। কোভিডের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনীতিতে আমরা যখন বিভিন্ন দিকে মগ্ন ছিলাম, সেই সময় আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। এটা ঠিক যে, আমাদের বাহ্যিক যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে, সে সম্পর্কে প্রজেকশন (ধারণা) করা যায় না। প্রজেকশন করতে তো এজামপশন (অনুমান) করা লাগে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেটি করতে পারবো না। এতটুকু চাপ তো অবশ্যই। সবাইকে কিন্তু এটি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।

এদিকে রফতানির তুলনায় আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার। যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা । গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট) যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে এ তথ্য উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পণ্য বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতি পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসেবে (প্রতি ডলার ৯০ টাকা) যার পরিমাণ ২ লাখ ৪৮ হাজার ১২১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮০১ কোটি ডলার। আর গত অর্থবছরের পুরো সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২ হাজার ২৮০ কোটি ডলার।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অস্বাভাবিক হরে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় বড় বাণিজ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে এনে, রপ্তানি রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। তা না হলে সংকটে পড়বে অর্থনীতি।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে রফতানি বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে আমদানি বেড়েছে ৪১ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই ১০ মাসে রফতানি থেকে দেশ আয় করেছে ৪ হাজার ১১০ কোটি ডলার। পণ্য আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৮৬৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৭৯৫ কোটি ডলার। যদিও সেবা খাতে দেশের ব্যয় হয়েছে ১১১৪ কোটি ডলার। সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ২১৫ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি হিসাব ভারসাম্যে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এই ঘাটতির (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৬৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সামগ্রিক লেনেদেনে (ওভার অল ব্যাল্যান্স) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ৭৫০ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৭৩০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে একই সময় এসেছিল ২ হাজার ১১২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমদানি বেশি হচ্ছে কিন্তু রফতানি ও রেমিট্যান্স কম আসছে। এখন ঘাটতি কমাতে হলে রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। এছাড়া বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমাতে হবে। একইসঙ্গে আমদানির নামে কী আসছে তা তদারকি করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি জানান, এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের মূল্য ৮৯ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না। এখন তা তুলে নিয়েছে। অর্থাৎ এতদিন পরে তারা বুঝতে পেরেছে এটা ঠিক হয়নি। এটা ভালো হয়েছে। এখন আমাদের এফডিআই বাড়াতে হবে যাতে করে ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট ঠিক রাখা যায়। বৈদেশিক মুদ্রার বাজার ঠিক রাখতে হলে হলে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।

চলতি হিসাব ভারসাম্যে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এই ঘাটতির (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৬৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সামগ্রিক লেনেদেনে (ওভার অল ব্যাল্যান্স) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ৭৫০ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৭৩০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে একই সময় এসেছিল ২ হাজার ১১২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও আগের বছরের চেয়ে ৫৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়ে ১৮৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১২১ কোটি ডলার।

https://dailysangram.info/post/491131