১ জুন ২০২২, বুধবার, ১০:৪৯

দুধে স্বয়ংসস্পূর্ণতায় গোখাদ্যের দাম বৃদ্ধি মূল চ্যালেঞ্জ

১১ বছরে দেশে দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ; ২০৩০ সালের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা

দেশে গত ১১ বছরে প্রায় ৫ গুণ বেড়েছে দুগ্ধ উৎপাদন। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারের কারণে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এখনো সম্ভব হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আয় স্বল্পতার কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত বেশির ভাগ পরিবারই এখনো দুধের স্বাদ নিতে পারছে না। দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এ মুহূর্তে গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধিসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে প্রাণিখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খামারিদের সহযোগিতার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দুগ্ধ উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রাখতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। সেক্ষেত্রে দুগ্ধশিল্প উন্নয়নে চার হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্প’ দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ দুধ উৎপাদন হয় এশিয়াতে। দুধ উৎপাদনে বিশ্বের একনম্বরে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। বাংলাদেশের অবস্থান (গরু, ছাগল ও মহিষের দুধ) বিশ্বের ২৩ নম্বরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারীসহ নানা কারণে দুধের সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকায় এমনিতেই ক্ষতির মধ্যে আছে খামারিরা। এ অবস্থায় গো খাদ্যের দাম বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের দুগ্ধ উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খামারিরা গাভী পালনে খরচই তুলতে পারছেন না।

খামারিরা বলছেন, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব, মানসম্পন্ন দুধ সরবরাহ না করা, ভেটেরিনারি চিকিৎসক সঙ্কট, দুধ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করতে না পারা, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং বিদ্যুতের মূল্য কৃষিভিত্তিক শিল্পের চেয়ে অনেক বেশি হওয়াও উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। উৎপাদন খরচের সাথে সমন্বয় করে দুধের দাম নির্ধারণের দাবিও উঠেছে খামারিদের পক্ষ থেকে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ বুধবার বাংলাদেশে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। ‘পরিবেশ, পুষ্টি ও আর্থসামাজিক ক্ষমতায়নে টেকসই ডেইরি সেক্টর’ এই শিরোনামে এবারের (২০২২) বিশ্ব দুগ্ধ দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সারা দেশে আজ থেকে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি পালন করবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে দুধের মূল উৎস গরু। ৯০ শতাংশ দুধ আসে গরু থেকে, আট শতাংশ আসে ছাগল থেকে এবং দুই শতাংশ আসে মহিষ থেকে। ১৯৮৯-৯০ থেকে ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ২.৪ শতাংশ, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১৬.৪৪ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ৩৪.৬০ লাখ মেট্রিক টন, যা বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে হয়েছে এক কোটি ১৯ লাখ ৮৫ হাজার লাখ টন।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা) ড. হোসেন মো: সেলিম জানান, গত বছর দুধের চাহিদা এক কোটি ৫৪ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ১৯ লাখ ৮৫ হাজার টন। অর্থাৎ প্রায় ৩৫ লাখ টন দুধ ঘাটতি ছিল গত বছর। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১২.৮৫ মিলিয়ন টন বা এক কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।

সূত্র বলছে, যদিও জনসংখ্যা জরিপ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তাই সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না যে, দেশের জনসংখ্যা এখন কতো। তবে বিবিএসের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিবেচনায় নিয়ে দেশের সম্ভাব্য জনসংখ্যা ১৭ কোটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার ধরলে দুধের চাহিদা এক কোটি ৫৬ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়ায়। অর্থাৎ দুধ উপাদন গত বছরের এক কোটি ১৯ লাখ ৮৫ হাজার টন থেকে বেড়ে যদি এক কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার টনেও দাঁড়ায় তা হলে ২৮ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি দুধের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

দুগ্ধ খাত-সংশ্লিষ্টদের হিসেবে দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার গুঁড়া দুধ আমদানি করা হয়, যা মোট দুধের চাহিদার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা মতে, দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয়, তার মাত্র সাত শতাংশ বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত হয়ে বাজারে আসে।

দুধের বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০০টি ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার (ভিএমসিসি) স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো: গোলাম রব্বানী। দুগ্ধশিল্প উন্নয়নে সরকার চার হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। গোলাম রব্বানী বলেন, আমাদের প্রকল্পের আওতায় যেসব খামারি যুক্ত, এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের ২০ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আর ৪০০ ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার স্থাপন কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। ফার্মার গ্রুপ রেডি না থাকলে এটা শুরু করা যাবে না। বছরের শেষের দিকে হয়তো এটা শুরু করতে পারব আমরা।

মিল্কভিটার সাবেক পরিচালক আবদুস সামাদ ফকির নয়া দিগন্তকে জানান, আগের চেয়ে খুব খারাপ অবস্থায় আছে দেশের খামারিরা। জাতীয়ভাবে বেশ কয়েকবার শ্রেষ্ঠ খামারির সম্মাননা পাওয়া সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের এই খামারি বলেন, গো-খাদ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। গত কয়েক বছরে গো-খাদ্যের দাম প্রায় ডাবল হলেও দুধের দাম বাড়েনি। এখনো ৩৮ থেকে ৪০ টাকা লিটারে বিক্রি করতে হয় আমাদের। তাহলে বুঝতেই পারছেন খামারিরা কেমন আছে?

নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেন, আগে আমার শতাধিক গাভী ছিল, বর্তমানে ৫০টিতে নেমেছে। তিনি বলেন, শুধু আমি নই। শাহজাদপুরে আগে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার গাভী ছিল। এটা বর্তমানে ৮০ হাজারে নেমেছে। সব ধরনের গো-খাদ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ সংখ্যা আরো কমার আশঙ্কা করছেন তিনি।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা: মনজুর মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা নয়া দিগন্তকে বলেন, এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় আমরা সারা দেশে পাঁচ হাজার ৫০০ দুধ প্রডিউসার গ্রুপ তৈরি করতেছি। এ ছাড়া আরেক প্রকেল্পর আওতায় ফার্মার্স গ্রুপ আছে। ওখান থেকে আবার আমরা প্রডিউসার গ্রুপ তৈরি করেছি ১২০টি। এলডিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের যে দুধের স্বল্পতা আছে তার পূরণ করব।

কত বছরের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের টার্গেট রয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করব। এ লক্ষ্যে আমরা কার্যক্রম চালাচ্ছি। খামারিরা যাতে উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত করতে পারেন, পণ্য যাতে প্রসেসিংয়ে আসে, ভ্যালু অ্যাডুশন হয় সেজন্য কাজ করা হচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ আছে কি না জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ডিজি বলেন, চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খাদ্যমূল্য (গো খাদ্য) বৃদ্ধি। এটা তো সারা বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জ। খাদ্যমূল্য বেড়ে গেছে। এটাকে কিভাবে মিনিমাইজ করা যায়। একদিকে আমরা ঘাস চাষ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। প্রকল্প হাতে নিয়েছি। পাশাপাশি আন্ত:মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন শুল্ক কমিয়ে কিভাবে সমন্বয় করা যায়, সহনশীল করা যায়, সে ব্যাপারে আমরা কাজ করছি।

এ দিকে, বিশ্ব দুগ্ধ দিবস উপলক্ষে আজ সকালে রাজধানীতে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। রাজধানীর ফার্মগেটে কেআইবি কনভেনশন হলে দিনব্যাপী প্রাণিজাত পণ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। কেআইবি অডিটোরিয়ামে ডেইরি আইকন সেলিব্রেশন উপলক্ষে কেআইবিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক, ডা: মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদার সভাপতিত্বে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশের ডেইরি সেক্টর : সম্ভবনা ও করণীয়’ শীর্ষক প্রেজেন্টেশন করা হবে।

 

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/667211