ঢাকার বাতাস দূষিত হওয়ার অন্যতম কারণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া। রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে তোলা।
৩১ মে ২০২২, মঙ্গলবার, ১:২৪

গাড়ির কালো ধোঁয়ায় ঢাকায় চলা দায়

কোনো রকমে পরনের গেঞ্জিতে নাক-মুখ ঢেকে ধরলেন রহমান মিয়া। রাজধানীর ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। নিজ গন্তব্যের বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় একটি বাস এসে একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে দিল।

দম নিতেই চোখ বন্ধ করে গেঞ্জিতে নাক-মুখ ঢাকতে হয় তাঁকে।
কাকরাইল মোড় থেকে রামপুরা যাওয়ার জন্য ভিক্টর ক্লাসিক নামের একটি বাসে ওঠেন জুবায়ের আলম। বসার সুযোগ পেয়েছেন বাসের একেবারে শেষ আসনের আগেরটিতে। তবু তিনি খুশি। তবে বিপত্তি টের পেলেন মালিবাগে উড়ালসেতু থেকে নামার পর। একটু পর পর কমতে থাকে বাসের গতি আর কালো ধোঁয়া এসে ঢুকতে থাকে জানালা দিয়ে। তাই একটু পর পর নাক উঁচিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা জুবায়েরের।

বাসের এমন বিষাক্ত কালো ধোঁয়া রাজধানীতে প্রায় নিয়মিত চিত্র। মূলত ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকেই কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। কালো ধোঁয়ার বেশির ভাগই আসে সড়কে চলা লক্কড়ঝক্কড় বাস থেকে। পরিস্থিতি এমন যে বাসের কালো ধোঁয়ায় অনেক সময় যেন বাতাসেরও ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের সঙ্গে ঢাকার বায়ুদূষণে বাসের কালো ধোঁয়ার ভূমিকা নিয়ে কথা হয়। তিনি জানান, সম্প্রতি তাঁরা একটি গবেষণা করেছেন। তাতে দেখা যায়, বর্তমানে ঢাকার মোট বায়ুদূষণের ১৫ শতাংশ হচ্ছে যানবাহনের কারণে। এর মধ্যে বাস ছাড়াও সব ধরনের যানবাহন রয়েছে। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণেই কালো ধোঁয়া সৃষ্টি হয়।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন গাজী বলেন, যানবাহনের কালো ধোঁয়ার মধ্যে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্রোমিয়াম, সিসা ইত্যাদি ক্ষতিকর উপাদান থাকে, যার কারণে মানবদেহে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ, দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ, ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি ও মস্তিষ্কের নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নিবন্ধিত মোটরযানের তালিকায় দেখা যায়, চলতি মাস পর্যন্ত দেশে মোটরযান রয়েছে ৫২ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৬টি। এর মধ্যে রাজধানীতে মোটরযানের সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৬ হাজার ৯৮৭। ঢাকায় চলা মোটরযানের মধ্যে ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৪১৮টি মোটরসাইকেল। বাস, পিকআপ, ট্রাক ও হিউম্যান হলার মিলিয়ে ঢাকায় চলে এক লাখ ৬৬ হাজার ১৮৪টি যান। এসব যানের এক-তৃতীয়াংশেরই ফিটনেস নেই।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ট্রাফিক) রমনা বিভাগের অতিক্তির উপকমিশনার মো. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকার যানজট সামলানো আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যেও বাসের ফিটনেস দেখা নিয়মিত কাজের মধ্যে পড়ে। বাস অতিরিক্ত কালো ধোঁয়া ছাড়ছে—এমনটা চোখে পড়লে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জরিমানার পাশাপাশি বাস জব্দও করা হয়। ’

দেশের মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নির্গত হলে তা জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে চলা যান জব্দ করতে বলা হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা মহানগরের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট শাখার উপপরিচালক মো. মোজাহিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, নিয়মিতই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কালো ধোঁয়া ছাড়ে—এমন যানবাহনকে জরিমানা করা হয়। এর পরও দেখা যায়, এগুলো চলছে।

কালো ধোঁয়া ছাড়ে—এমন যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের নানা সীমাবদ্ধতার কথা জানালেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ট্রাফিক বিভাগের প্রধান মো. মুনিবুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাস থেকে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে কি না, তা পরীক্ষা করার যন্ত্র আমাদের কাছে নেই। আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে চেয়েছি, কিন্তু পাইনি। ’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা খালি চোখে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখলে বাসের ফিটনেস বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কালো ধোঁয়া পরিমাপ করার যন্ত্র ব্যবহার করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতি থাকা দরকার। তাই চাইলেও কালো ধোঁয়ার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারি না। ’

সম্প্রতি রাজধানীর গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, পল্টন, ফার্মগেট, মহাখালী, মগবাজার, শান্তিনগর, বংশাল, বনানী, রামপুরাসহ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে অনেক বাস থেকে অতিরিক্ত কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। রাতে চলাচল করা ট্রাক থেকেও অতিরিক্ত কালো ধোঁয়া বের হওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে প্রায়ই। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় চলা হিউম্যান হলার (লেগুনা) থেকেও কালো ধোঁয়া বের হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাসের কালো ধোঁয়া বা ফিটনেস নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। বাসের এসব মনিটর করার কাজ আমাদের সংগঠনের না। নজরদারি করবে বিআরটিএ। এখন বিআরটিএ যদি তাদের কাজ না করে তাহলে আমরা কী করব? পুলিশ তো জরিমানা করে। আমরা তো কিছু বলি না। প্রতিদিনই তো আর গাড়ি ঠিক করা যাবে না। ’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2022/05/31/1151083