৩১ মে ২০২২, মঙ্গলবার, ১:০৭

ঢাকায় পানির উৎসের গোড়ায় গলদ

ঝুঁকিতে ৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকার প্রকল্প

ছয় বছরেও খননের জটিলতা কাটেনি * আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চরম বিপদের আশঙ্কা * পানি পানের উপযোগী করতে বছরে বাড়তি খরচ হাজার কোটি টাকা

ঢাকায় সরবরাহ করা পানির উৎসের গোড়ায় গলদ। এ কারণে পানি সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপনে হাতে নেওয়া ৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের সুফলপ্রাপ্তি ঝুঁকিতে রয়েছে। উপরন্তু এসব পাইপ দিয়ে ঢাকায় সরবরাহ করা পানি ফুটানোসহ বিশুদ্ধকরণ করতে নাগরিকদের বাড়তি অর্থ গুনতে হবে। এই ব্যয় প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা, যা বছরে দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট’ শীর্ষক প্রকল্পটির নিবিড় পরিবীক্ষণ করতে গিয়ে এমন চিত্র উঠে এসেছে। এদিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নেও বিরাজ করছে ধীরগতি। ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও গত বছরের জুন পর্যন্ত এটির বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২০ দশমিক ৫২ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে ৭৭৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। দীর্ঘ সময়েও খননকাজের জটিলতা নিয়ে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশন কোনো সমাধানে আসতে পারছে না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তৈরি করা এ পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনটি জুনে চূড়ান্ত করা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

আইএমইডি সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, চূড়ান্ত হওয়ার পর এটিসহ মূল্যায়ন করা অন্য প্রতিবেদনগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। শুধু তাই নয়, তারিখ নির্ধারণ করে দিয়ে কী ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হবে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে উত্তর না পেলে আবারও চিঠি দেওয়া হবে। এতেও কাজ না হলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করা হবে। তিনি আরও বলেন, আইএমইডির তো শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা নেই। কাজেই যেটুকু দায়িত্ব আছে, সেটিই পুরোপুরি পালন করা হবে।

সূত্র জানায়, ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩ হাজার ১৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের অর্থও আছে। পরবর্তী সময়ে ব্যয় বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনীতে করা হয় ৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। শুরুতেই ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বর্ধিত মেয়াদের মধ্যেও শেষ হবে কি না, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে আশঙ্কা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতায় ঢাকা ওয়াসা।

আইএমইডির খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুষ্ক মৌসুমে পানির চাপ কম এবং পানির পরিমাণ আশানুরূপ থাকছে না। প্রকল্পটির কাজ দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে বাস্তবায়ন ব্যয় বৃদ্ধি ও রাজস্ব আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নের ফলে পুরো শহরের মানুষের সুপেয় পানি পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। কারণ সরবরাহ করা পানি ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে খেতে হচ্ছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি নেটওয়ার্কিং প্রকল্প। পানির উৎসের উন্নয়নের মাধ্যমে সুপেয় পানির বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে। আরও বলা হয়েছে, পানির উৎস উন্নয়ন না হলে এই প্রকল্পের আওতায় যে পানি সরবরাহ করা হবে, তা নিরাপদ হবে না। এ পানি নিরাপদ ও সুপেয় করতে জ্বালানো বা পরিশোধনের জন্য প্রতিদিন গড়ে ৩/৪ কোটি টাকা শহরবাসীকে ব্যয় করতে হবে। বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে। সেই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে পানির যে পরিমাণ চাপ থাকার কথা ছিল সেটি নেই। এ অবস্থায় ঢাকার প্রায় ৮০ ভাগ ভবনে টানা মোটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে বিল বাবদ নগরবাসীকে দৈনিক ২/৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে সুপেয় ও নির্ভরযোগ্য পানির বিষয়টি বলা আছে। কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শনের সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্পটে দৃশ্যমানভাবে দূষিত পানি দেখা গেছে। আরও বলা হয়েছে, মাঠ পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা যথাযথ নেই। এছাড়া প্রকল্পের টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরির সময় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার অভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে রাস্তা খনন কাজে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকল্পটির জন্য ৭ ধরনের হুমকি আছে বলে উল্লেখ করেছে আইএমইডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খননকাজে সিটি করপোরেশন অতিরিক্ত চার্জ নির্ধারণ করায় ঠিকাদার সময়মতো কাজ করতে পারেনি। এ কারণে প্রকল্পের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চরম বিপদ দেখা দেওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। করপোরেট ব্যবস্থাপনার ধারণা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জনগণের কষ্টার্জিত আয় থেকে অতিরিক্ত পানির বিল দিতে হচ্ছে। এতে সরকারের সদিচ্ছাপ্রসূত প্রকল্পটি জন-অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। খননকাজে সিটি করপোরেশন অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক দাবি করছে। প্রচলতি রেট শিডিউল অনুসারে খননকাজের চার্জ যথাযথভাবে ধার্য করা হয়নি। এছাড়া ঢাকা শহরের স্বল্প ও নিু আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে পানির বিল কেমন হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। প্রকল্পটির জন্য ছয় অর্থবছর চলে গেছে। কিন্তু তারপরও ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে খননকাজ নিয়ে ফলপ্রসূ সমাধান হয়নি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/556736