৩১ মে ২০২২, মঙ্গলবার, ১:০১

আমের ব্র্যান্ডিং ইমেজ সৃষ্টি না হওয়ায় রপ্তানিতে কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী আমের ব্র্যান্ডিং ইমেজ সৃষ্টি না হওয়ায় আম রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনার সুফল পাচ্ছে না আম চাষিরা। এছাড়া উৎপাদিত আমের সেলফ লাইফ কম থাকা, কৃষির উত্তম চর্চার অভাব, রপ্তানিযোগ্য উচ্চমূল্যের জাতের অপর্যাপ্ততা, নজরদারি, নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক গুণগত মানসম্পন্ন আমের জাত নির্বাচন ও উৎপাদনে ঘাটতি, নতুন বাজার যাচাই ও সৃৃষ্টিতে উদ্যোগ গ্রহণে সমন্বয়ের অভাবে কাক্সিক্ষত সফলতা পাচ্ছে না দেশের আমের বাজার।

বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম হলেও, পণ্যটি রপ্তানি আয়ের দিক থেকে একদমই তলানিতে ছিল। বাংলাদেশের চেয়েও কম পরিমাণ আম উৎপাদন করে অনেক দেশ রপ্তানি থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। সরকারি হিসেবে গত বছর বাংলাদেশের আমের উৎপাদন ছিল ১৪ লাখ মেট্রিক টন। যা বিশ্ব উৎপাদনের দুই দশমিক ছয় ভাগ। সপ্তম উৎপানকারী দেশ হয়েও বাংলাদেশ মাত্র পাঁচ লাখ মার্কিন ডলারের আম রপ্তানির সুযোগ পেয়েছে।

বিশেজ্ঞরা বলছেন, দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি অতি নগণ্য। অথচ ২০২০ সালে থাইল্যান্ড বিশ্বের সর্বোচ্চ ৭৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের আম রপ্তানি করেছে। একইসময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ১৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং পাকিস্তান ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের আম রপ্তানি করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আম রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে রপ্তানিযোগ্য উন্নত জাতের আমের অভাব। স্থানীয় আমের জাতগুলোর শেলফ লাইফ কম, অর্থাৎ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া, মানসম্মত কৃষি পদ্ধতির চর্চা, আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং এর অভাব এবং বাংলাদেশী আমের ব্রান্ডিং সংকটের কারণে এতদিন আম রপ্তানিতে সুফল আসেনি।

বর্তমানে দেশে ২৩টি জেলায় আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হলেও সারাদেশেই কম বেশি আম চাষ হয়ে আসছে। আম উৎপাদনকারী প্রধান জেলাগুলোর ৮০-৮৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমের ওপর নির্ভরশীল এবং ওই জেলাগুলোর অর্থনীতি ও মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা অনেকাংশেই আমের ওপর নির্ভরশীল । বর্তমানে উৎপাদিত আমের ৮৫ শতাংশ সরাসরি খাওয়ার জন্য (তাজা ফল হিসেবে) এবং অবশিষ্ট ১৫ শতাংশ প্রক্রিয়াজাতের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আমের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। দেশে বর্তমানে ৯৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১২ দশমিক ১৯ লাখ টন আম উৎপাদন হয়। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে জমির পরিমাণ ও উৎপাদন আরো বেশি। তাদের মতে, সারাদেশে আম উৎপাদন এলাকা প্রায় ২ লাখ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন ২৫ লাখ টন। তবে আম উৎপাদনের সঠিক চিত্র প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে উঠে আসবে। দেশে ও বিদেশে প্রতি বছর এ দেশের সুস্বাদু আমের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর ২৩টি দেশে বাংলাদেশের আম রপ্তানি হচ্ছে।

জলবায়ু ও ভৌগিলিক কারণে দেশে সবার আগে আম পাকে সাতক্ষীরায়। তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে এ বছর ফলন কম হয়েছে। তাই লোকসানের আশঙ্কায় আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা। সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ বছর জেলার ৫০ ভাগ গাছে আমের মুকুল আসেনি। কেননা আমগাছে যখন মুকুল আসবে, ঠিক তার আগ মুহূর্তে হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় মুকুল আসতে পারেনি। অন্যদিকে আমে গুটি আসার পর বৃষ্টির অভাবে আমের ফলনও তেমন ভাল হয়নি।

এরপরও যে আম হয়েছে তার বাজার মূল্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছে আম চাষিরা। সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, গত বছর ৪ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছিল। চলতি বছর ৪ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। আবাদ বাড়লেও এ বছর ৫০ ভাগ গাছেই আসেনি আমের মুকুল। জেলায় ৫ হাজার ২৯৯টি আমবাগান ও ১৩ হাজার আমচাষি রয়েছে। সাতক্ষীরার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, চলতি বছর জেলায় আমের ফলন খুব কম হয়েছে। তবে বাজারে আমের দাম ভাল পেয়ে খুশি আম চাষিরা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ১ হাজার ৬২৩ টন আম বিদেশে রপ্তানি করা হয়। আম যায় ইংল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও হংকংয়ে। দেশে উৎপাদিত ৮,৮৯,১৭৬ টন আমের বেশির ভাগই দেশের ক্রেতারা ক্রয় করে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে আম আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান। দেশের প্রধান আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো হলো- সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। দেখা যায়, সাতক্ষীরা জেলায় আম বাজারে প্রথম আসে এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় সেগুলো বাজারজাত করা হয়।

বিশেজ্ঞরা বলছে, এদেশের মাটি, জলবায়ু ও ভৌগলিক অবস্থান উপযোগী হওয়ায় এবং শ্রমিকের সহজলভ্যতা থাকায় গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট আম উৎপাদন সম্ভব। আন্তর্জাতিক বাজারে আমের স্থায়ী রপ্তানি বাজার রয়েছে এবং এথনিক ও নিচি মার্কেটের সুবিধাও রয়েছে। বিধায় বর্তমানে বিদেশে আম রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আমদানি রপ্তানি ব্যুরো এবং হর্টেক্স ফাউন্ডেশনকে সক্রিয় হতে হবে। এছাড়া আম রপ্তানির জন্য বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান করা;বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আমের মৌসুমে আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো পরিদর্শন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা; বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশীয় আম বাগান পরিদর্শন করানো; আম রপ্তানি করার জন্য প্যাকেজিং সামগ্রির ওপর ভর্তুকি প্রদান করা; এবং আম রপ্তানির জন্য একটি কার্যকর নীতিমালা বাস্তবায়ন দরকার। আমের রপ্তানি বাড়াতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘ দেশের আম আমরা ব্যাপকভাবে বিশ্ববাজারে নিয়ে যেতে চাই। সে জন্য রপ্তানি বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনে কাজ চলছে।

https://dailysangram.com/post/490795