৩১ মে ২০২২, মঙ্গলবার, ১১:২৭

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ও সূচনালগ্নের কিছু কথা

-ড. মো. নূরুল আমিন

অনেক বাধা বিপত্তি ও অনিশ্চয়তার পর স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং আগামী ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এই সেতুটি উদ্বোধন করবেন। এর ফলে দক্ষিণ বঙ্গের সাথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগে আর কোন প্রতিবন্ধকতাই থাকবে না। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ত্বরান্বিত হবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি ঘাটে গিয়ে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার প্রভৃতি পরিবহন নিয়ে মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে না। তাদের প্রতীক্ষা ও দুর্দশার অবসানের সাথে পদ্মা সেতু আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকেও নিঃসন্দেহে বেগবান করবে। সেতুটির কাজ সম্পন্ন করায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ধন্যবাদ পাবার যোগ্য বলে আমি মনে করি। তবে এই সেতুকে নিয়ে সাম্প্রতিক কালে দেশে যে বিতর্ক চলছে তাকে আমি শুধু অনভিপ্রেত নয়, সত্যের অপলাপ বলেও মনে করি। এখানে এই সেতুর বিরোধিতার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনুস অথবা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দায়ী করে পদ্মা সেতু থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে চুবানোর মতো মন্তব্য শালীন বলে মেনে নেয়া যায় না। আমি মনে করি বাংলাদেশের সবাই দেশপ্রেমিক এবং সবাই সম্মানিত ব্যক্তি। মানির অপমান বজ্রঘাত তুল্য। এই ছোট কথাটা আমাদের স্মরণ রাখা দরকার। এর সাথে এই সেতু নির্মাণের সূচনালগ্নে কি ঘটেছিল তাও জাতিকে স্মরণে রাখা উচিত। এখন আমি একটু দেখি সেদিন কি ঘটেছিল।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০১১ সালে পদ্মাসেতুর কাজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই দাতা সংস্থাগুলোর কাছে দুর্নীতি ধরা পড়ায় তারা অর্থায়ন স্থগিত করে দেয়। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠে। তৎকালীন সময়ের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে তাদের তদন্ত রিপোর্ট তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেছিল। আরেক দাতা সংস্থা কানাডিয়ান সিডাও অনুরূপ আরেকটি রিপোর্ট পেশ করে। বিশ্বব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পত্রপত্রিকা সূত্রে দেশাব্যাপী জানতে পেরেছিল যে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংকে তাদের প্রতিশ্রুত ১২০ কোটি ডলার (প্রায় ৯১২০ কোটি টাকা) ছাড়ের বিষয়টি স্থগিত করে দিয়েছে। ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক তাদের তদন্ত রিপোর্টের একটি সার সংক্ষেপ অর্থমন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে বলেছিল যে, যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির গ্রহণযোগ্য তথ্য প্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে।

বিশ্ব ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ সেতু বিভাগ ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল অগ্রিম কার্যাদেশের মাধ্যমে পদ্মা সেতুর জন্য প্রাকযোগ্যতা যাচাই এর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। কিন্তু ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর দুর্নীতির মাধ্যমে এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রাকযোগ্যতার শর্ত পরিবর্তন করা হয় এবং প্রাকযোগ্যতা যাচাই এর প্রক্রিয়াও বাতিল করা হয়। এর পরদিন অর্থাৎ ১১ অক্টোবর সেতু কর্তৃপক্ষ পুনরায় প্রাকযোগ্যতা তালিকার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিশ্ব ব্যাংক ২০১১ সালের জুলাই মাসের শুরুতে প্রধান সেতু চুক্তির প্রাকযোগ্যতা তালিকায় অনাপত্তি প্রদান করে। এই অনাপত্তির পরপরই বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি (আইএনটি) দফতর যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও তার কোম্পানি সাকোর (ঝঅঐঈঙ) ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিদের ব্যাপারে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ পায়। এসব অভিযোগে বলা হয় যে সাকো এই প্রকল্পে পরোক্ষ কমিশন এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আইএনটি তদন্ত হাতে নেয় এবং পাঁচ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ৪টি দেশের সম্পৃক্ত এক ডজনেরও বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলে। তদন্তকালে আইএনটির হাতে গ্রহণযোগ্য এমন কিছু তথ্য প্রমাণ আসে যা যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ও তার কোম্পানি সাকোর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের সত্যতা প্রমাণ করে। বলাবাহুল্য তথ্যের উৎস গোপন রাখার শর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ আইএনটিকে তথ্যাদি প্রদান করেছে। এতে দেখা যায় যে, আবুল হোসেনের কোম্পানি সাকোকে সাইলেন্ট এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ ও মোটা অংকের ফি দেখার শর্তে কাজ পাইয়ে দেয়ার ব্যাপারে মন্ত্রী আবুল হোসেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আশ্বাস দিয়েছেন এবং অন্যথা হলে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। আইএনটিকে একটি কোম্পানির কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, তার কাছে সাকোর পরিচয়ে এক ব্যক্তি দেখা করতে আসে এবং বলে যে সে যোগাযোগ মন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে এসেছে। সাকোর ঐ প্রতিনিধি তাকে বলেছে, পদ্মা সেতুর মোট চুক্তি মূল্যের একটি অংশ কমিশন হিসেবে দিলে পদ্মার মূল সেতু নির্মাণের প্রাকযোগ্যতা বাছাইয়ে ঐ কোম্পানিকে মন্ত্রী প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন।

আইএনটি আরো বলেছে মন্ত্রী হবার পর সৈয়দ আবুল হোসেন তার কোম্পানি সৈয়দ আবুল হোসেন এন্ড কোম্পানি (সাকো) থেকে পদত্যাগ করলেও ওয়েবসাইটে দেখা গেছে যে এ প্রতিষ্ঠানের তিনজন পরিচালকের মধ্যে একজন হচ্ছেন তার স্ত্রী খাজা নার্গিস হোসেন ও দুই মেয়ে যথাক্রমে সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেন। বিশ্ব ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন তার প্রতিষ্ঠান সাকোকে কমিশন এজেন্ট করার জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানকেও চাপ দিয়েছেন। এজন্য তিনি তাদের ভয়ভীতিও প্রদর্শন করেছেন। এই রিপোর্টে সেতুর প্রাকযোগ্যতা প্রক্রিয়ায় অসংখ্য দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, যোগাযোগমন্ত্রী ও সাকোর কর্মকর্তারা মিলে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন যাতে প্রতীয়মান হয় যে, কাজ পাইয়ে দিতে সাকো এক ধরনের নীরব এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। কোন কাজ পেতে হলে কিংবা প্রাকযোগ্যতায় টিকতে হলে সাকোকে অর্থ দিতে হবে।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, তদন্ত কাজ শেষ করতে বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। সাক্ষাৎদাতারা ভয় পাচ্ছিলেন। যোগাযোগমন্ত্রী অত্যন্ত ক্ষমতাশালী লোক, তাদের চাকরি ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয় রয়েছে এবং তারা তাদের ব্যক্তি নিরাপত্তা ও আর্থিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নাম গোপন রাখার অনুরোধ করেছেন। বিশ্বব্যাংক আইএনটি রিপোর্টের তথ্য অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করে বাংলাদেশ সরকারকে নিবিড় তদন্তের পরামর্শ দিয়েছে এবং এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। উল্লেখ্য যে, আইএনটির তদন্ত রিপোর্টের পর বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেছে এবং বলেছে যে, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত না দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যাপারে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থ সহায়তা নিয়ে কোনও প্রক্রিয়া শুরু করবেন না। বলাবাহুল্য পদ্মা সেতুর মোট ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ২৯০ কোটি ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ২২,২৪০ কোটি টাকার সমান। এর মধ্যে ১২০ কোটি ডলার বিশ্ব ব্যাংক দেয়ার কথা ছিল, যা তারা এখন স্থগিত করেছে। বিশ্বব্যাংকের অনুসরণে দুর্নীতির কারণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাইকাও তাদের প্রতিশ্রুত ১০১ কোটি ডলার ঋণ সহায়তাও স্থগিত করে দেয়।

একইভাবে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও পদ্মা সেতুর বিপরীতে তাদের অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দেয়। উপরে আমি পদ্মা সেতুর দুর্নীতি বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টের যে বিবরণী তুলে ধরেছি তা তিনটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত। এই সূত্রগুলো হচ্ছে বিশ্বব্যাংক আবাসিক দফতর, গণমাধ্যম এবং অর্থ মন্ত্রণালয়।

তখন কেউ কেউ সরকারি পদ থেকে বলেছিলেন যে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার হুদার বিরুদ্ধে দুর্নীতির দুটি ডকুমেন্ট বিশ্বব্যাংকের কাছে গেছে এবং এর পরপরই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন স্থগিত করেছে। এই ঘটনায় প্রায় পাঁচ বছর আগে জনাব নাজমুল হুদা যোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে কেয়ারটেকার সরকারের আমলে। প্রধানমন্ত্রী এ কথাটাও বলেছেন। এটা আমরা সবাই জানি। বিশ্বব্যাংকও জানে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এত বছর পর বিশ্বব্যাংকের কাছে দুর্নীতির ডকুমেন্ট দুটি কেন গেল এবং কে পাঠিয়েছে। আবার বিশ্বব্যাংকই বা কেন নাজমুল হুদার দুর্নীতির অজুহাত না দেখিয়ে সৈয়দ আবুল হোসেনের দুর্নীতির তদন্ত রিপোর্টের বরাত দিয়ে অর্থ সাহায্য বন্ধ করতে গেল। বিশ্ব ব্যাংকের ন্যায় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এ ধরনের রাখঢাক ও কারচুপি কি শোভা পায় । বিশ^ব্যাংক এ ব্যাপারে কিছু বলেনি।

আবার বিশ্ব ব্যাংকের কাছে নাজমুল হুদার দুর্নীতির ডকুমেন্ট দুটি নিশ্চয়ই আপনা আপনি যায়নি। জনাব হুদা ও তার দলও পাঠিয়েছে বলে ধরে নেয়া যায় না। তাহলে ডকুমেন্ট দুটি কারা পাঠিয়েছে তা চিহ্নিত হওয়া দরকার। কেননা এ দুটি ডকুমেন্ট বাংলাদেশের বিরাট ক্ষতি করেছে। আর যারা পাঠিয়েছে তাদের আমরা বন্ধু বলে মনে করতে পারি না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আর একটি দিকও আছে যা হয়ত তিনি ভুলে গেছেন। কেয়ারটেকার সরকারের আমলে অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির মামলা হয়েছিল এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এসব মামলার আসামী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ছিল ১৫টি, যে মামলাসমূহ ক্ষমতায় আসার পর তিনি রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছেন। যেমনটি করেছেন তার দলের অন্যান্য নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত মামলাসমূহও। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ যদি কেয়ারটেকার আমলের দুর্নীতির মামলার কারণে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে থাকে তা হলে শুধু নাজমুল হুদা কেন, প্রধানমন্ত্রীসহ তার দলের সিনিয়র মন্ত্রীদের রেকর্ড দেখলেও তো পারতো। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য জনসভায় নাজমুল হুদার দুর্নীতিকে সাহায্য বন্ধের কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেও অন্যত্র নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে দায়ী করে বলেছেন, যে তিনি বিশ্বব্যাংকের উপর প্রভাব খাটিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থ সাহায্য স্থগিত করিয়েছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, প্রধানমন্ত্রীর এই অভিযোগটির সত্যতা নিয়েও ইতোমধ্যে অনেক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ করেছেন। অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে প্রধানমন্ত্রীর এ অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে সহায়তা না করতে বা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করতে বিদেশে প্রচারণা চালিয়েছেন বলে যা বলা হচ্ছে সে ব্যাপারে কোন তথ্য প্রমাণ নেই। তিনি আরও বলেছেন যে বিদেশী সহায়তা বন্ধের ব্যাপারে যা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। এখন বিশ্বব্যাংকের তদন্ত রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং অর্থমন্ত্রীর জবাব এই তিনটি বিষয় সামনে নিয়ে বিশ্লেষণ করলে এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট ও অর্থমন্ত্রীর অবস্থানের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার শুরুতেই বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থাসমূহ যোগাযোগমন্ত্রী জনাব আবুল হোসেনের কিছু আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেখানে তাদের ধারণা অনুযায়ী দুর্নীতি হয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেন এন্ড কোম্পানি (সাকো) নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও স্বত্বাধিকারী হচ্ছেন যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব আবুল হোসেন। তিনি প্রাক যোগ্যতা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে ইচ্ছুক কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে তার কোম্পানিকে কমিশন এজেন্ট নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন এবং মন্ত্রী হিসেবে তার প্রভাব এবং সরকার প্রধানের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা আদায় করেছেন বা আদায়ের চেষ্টা করেছেন, যা বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের নীতিমালা অনুযায়ী দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক তাদের রিপোর্টটি অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে হস্তান্তর করেছেন, রিপোর্টটি তারা প্রধানমন্ত্রীকে দেননি, কেননা অর্থমন্ত্রীই হচ্ছেন বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংকের গভর্নর। তারা আশা করেছেন যে অর্থমন্ত্রী গভর্নর হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করবেন এবং দুর্নীতির বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সেতুর অর্থায়ন প্রক্রিয়া তারা স্থগিত রেখেছেন। অর্থমন্ত্রী বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী তখন যেভাবে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তাতে মনে হয়েছে যে তিনি যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে রক্ষা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তার মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি তার পক্ষাবলম্বন করবেন এতে হয়ত দোষের কিছু নেই। কিন্তু যখন বিশ্বব্যাংকের তদন্ত রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি তথ্য তিনি জাতির সামনে তুলে ধরেন তখন হতবাক না হয়ে পারা যায় না। মূল অভিযুক্ত যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের ব্যাপারে তিনি নীরব থেকে দোষ চাপালেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার উপর। পরে ড. ইউনূসকেও এজন্য দায়ী করলেন, যাকে তার অর্থমন্ত্রী স্বয়ং নির্দোষ ঘোষণা করলেন। প্রধানমন্ত্রী এর আগে এও বলেছিলেন যে পদ্মা সেতুর কাজই শুরুই হয়নি। কাজেই দুর্নীতির প্রশ্নই আসে না। তার এই মন্তব্যের পর জানা গেল যে এই সেতু বাবদ ইতোমধ্যে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। যদি কাজ শুরুই হয়ে না থাকে তাহলে তার সরকার এ টাকা ব্যয় করল কোথায়? আবার বিশ্ব ব্যাংকের তদন্ত রিপোর্ট যদি অসত্য হয় তাহলে বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার জন্য সরকার বিশ্ব ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য আমরা কি বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে পারি না? বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট নিয়ে যখন চারদিকে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায় তখন হঠাৎ করে শোনা গেল যে, মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশকে সহজ শর্তে অর্থ সহায়তা দিতে প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রস্তাব নিয়ে সরকার আগাচ্ছেন না কেন? এখন আবার শোনা যাচ্ছে পদ্মা সেতু থেকে যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে বাদ দিয়ে প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে নেয়া হচ্ছে। আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করার পর বিশ্ব ব্যাংকের শর্তাবলী মানার পদক্ষেপ হিসেবে সরকার শিগগির এই সিদ্ধান্তটি কার্যকর করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেই এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি হবে। এগুলো সব আগের কথা। এখানে ভুল ভ্রান্তি ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছিল। সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরে যেতে হয়েছে। যেভাবেই হোক পদ্মা সেতু হয়েছে এখন কি আমরা সব ভুলে এগিয়ে যেতে পারিনা।

https://dailysangram.com/post/490755