৩০ মে ২০২২, সোমবার, ১১:৩১

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সুদহার বাড়ল

সঙ্কট মেটাতে বাড়বে ব্যাংকের ব্যয় : চাপ মূল্যস্ফীতিতে

ব্যাংকগুলোর টাকার সঙ্কট দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়া হয়। এজন্য বন্ধক রাখা হয় ব্যাংকের হাতে থাকা সরকারের ঋণের বিপরীতে দেয়া ট্রেজারি বিল ও বন্ড। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নির্ধারিত হারে সুদও গুনতে হয় ব্যাংকগুলোকে। কিন্তু এ নীতিনির্ধারণী সুদহারও বাড়িয়ে দিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে ১০০ টাকা ধার নিতে ব্যয় করতে হবে ৫ টাকা, যা আগে ছিল পৌনে ৫ টাকা। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে এমনই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আমদানির চাহিদা বাড়ছে। এতে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা। কিন্তু এই চাহিদার বিপরীতে যে পরিমাণ ডলার সরবরাহ হওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে না। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে পরিমাণ ডলার আসছে, বিপরীতে আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে তার চেয়েও বেশি। এর ফলে স্থানীয় বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। অপর দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সবধনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে সরাসরি এর প্রভাব পড়েছে। প্রতিটি পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নীতিনির্ধারণী সুদহার অর্থাৎ রেপো হার বাড়িয়ে দেয়ায় ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে বাড়বে ঋণের সুদহার। আর এর প্রভাবে স্থানীয় বাজারেও পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে যাবে। সবমিলেই উদীয়মান মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেবে বলে ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন।

জানা গেছে, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণের জোগান দেয়। আর এ ঋণের বিপরীতে ট্রেজারি বিল ও বন্ড দেয়া হয়। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিলে দেয়া হয় ট্রেজারি বন্ড, আর এক বছরের কম মেয়াদে ঋণ দিলে দেয়া হয় ট্রেজারি বিল। ব্যাংকগুলোর হাতে এমন তিন লাখ ১৬ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে। এ হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত মার্চ প্রান্তিক পরিসংখ্যানের।

ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এ ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে নগদ চাহিদা মিটিয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়াকে ব্যাংকিং ভাষায় রেপো বলা হয়। বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমানোর জন্য রেপোর সুদহার বাড়িয়ে দেয়। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যায়। বেড়ে যায় সুদহার। তখন কম পরিমাণ ঋণ নেয়া হয় ব্যাংক থেকে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত দুই বছরে করোনাভাইরাসের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ আদায়ের ওপর এক ধরনের শিথিলতা দিয়েছিল। বলা হয়েছিল ঋণ আদায় না করলেও গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না। এ কারণে নগদ আদায় ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। অপর দিকে করোনা পরিস্থিতিতে আয় কমে যাওয়ায় মানুষ আগের মতো সঞ্চয় করতে পারছে না। এতে কমে গেছে আমানতপ্রবাহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যেখানে সাড়ে ৬৩ শতাংশ, চলতি অর্থবছরে একই সময়ে তা না বেড়ে বরং প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৪৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।

এ দিকে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ চাহিদা বেড়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অপর দিকে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকই চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ টাকা দিয়ে ডলার কিনছে। চলতি অর্থবছরের গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার কিনেছে কেন্দ্রেীয় ব্যাংকের কাছ থেকে। এতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ওপরে ব্যাংকের অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চলে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর তারল্য প্রবাহে। এমনি পরিস্থিতিতে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ তারল্য সহায়তা ও রেপো ও বিশেষ রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে টাকার জোগান দেয়া হচ্ছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এক দিকে ব্যাংকগুলোতে টাকার সঙ্কট, পাশাপাশি ডলার সঙ্কট এবং সেই সাথে জ্বালানি তেলসহ আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে রেপোর সুদহার বাড়িয়ে দেয়ায় ব্যাংকগুলো নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলো সরাসরি সুদ বাড়াতে না পারলেও নানা সার্ভিস চার্জ আরোপ করবে বিনিয়োগকারীদের ওপর। এতে বিনিয়োগ ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। আর বিনিয়োগ ব্যয় বাড়লে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে বেড়ে যাবে মূল্যস্ফীতি।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে গেছে। আর টাকার প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতেই রেপোর সুদহার বাড়ানো হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/666621