৩০ মে ২০২২, সোমবার, ১১:২৮

ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেস রোডে খরচ বাড়ছে ২৮২ শতাংশ

দেশের প্রথম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের তুলনায় ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে খরচ বাড়ছে ২৮২ শতাংশ। ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয় আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। এতে প্রতি কিলোমিটার রাস্তার জন্য গড় খরচ পড়ে ১৯১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অন্য দিকে ঢাকা-আশুলিয়া ২৪ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। এতে ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণে খরচ পড়ছে প্রতি কিলোমিটারে ৭৩১ কোটি টাকা। এতে প্রতি কিলোমিটারে গড় খরচ বাড়ছে ৫৪০ কোটি টাকা। অথচ দেশের বৃহত্তম প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণে মোট খরচ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার।

প্রায় চার বছরের ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে প্রকল্পটি এখন প্রায় ৯ বছরে দাঁড়াচ্ছে। চার বছর পাঁচ মাসে এই প্রকল্পে এক হাজার ৪০৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মূলত জমি অধিগ্রহণে। এ পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি দেখাতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু বিভাগ। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনের ঋণচুক্তি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি যা হয়েছে তা প্রদর্শন করা যাচ্ছে না।

দেশের প্রথম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুরু হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের কুতুবখালীতে শেষ হবে। হজরত শাহজালাল (রহ:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী অংশের প্রকল্পের অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়েছে। তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর ও সায়েদাবাদ অংশের কার্যক্রম চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।

এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক হিসাবে কাজ করবে। এটি হেমায়েতপুর-কদমতলী-নিমতলী-সিরাজদিখান-মদনগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-মদনপুরে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। অন্য দিকে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করবে। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলোও ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। ফলে ঢাকা ও পাশের এলাকার যানজট কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঢাকার এই প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের তুলনায় ঢাকা-আশুলিয়া ২৪ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে খরচ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। যানজট নিরসনের জন্য নেয়া এই প্রকল্পের ব্যয় নতুন করে ৬৫২ কোটি টাকা বা প্রায় ৪ শতাংশ বেড়ে এখন ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ৭৩১ কোটি টাকা। শুধু উপরের রাস্তায় প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৩৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রতি কিলোমিটার র্যাম্পসে খরচ ৪৯.৩২ কোটি টাকা এবং ব্রিজে ব্যয় ১১৯ কোটি টাকা।

সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনায় সেতু বিভাগের তথ্য থেকে জানা গেছে, যানজট নিরসন ও ঢাকার সাথে ৩০ জেলার যোগাযোগ সহজতর করতে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়া হয় ২০১৭ সালে। ১৬ হাজার ৯০১ কোটি ৩২ লাখ ২১ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত করার কথা ছিল। প্রকল্পটির মূল্য উদ্দেশ্য ঢাকা ও এর পাশের আশুলিয়া অংশে যানজট নিরসন করা।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকার সাথে ৩০ জেলার সহজ সংযোগ স্থাপন হবে। আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল-চন্দ্রায় এলাকা যানজট মুক্ত হবে। প্রকল্পটি নির্মাণ-পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)। চূড়ান্তভাবে নকশা অনুমোদনের পর ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করেছে করেছে সেতু বিভাগ। এক্সপ্রেসওয়ের সাথে ১০.৮৪ কিলোমিটার র্যাম্প এবং ১৪.২৮ কিলোমিটার সড়ক। এখানে দু’লেন করে চার লেনের সার্ভিস রোড হবে।

জানা গেছে, উড়াল সড়কটি হজরত শাহজালাল (রহ:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়ক থেকে শুরু হয়ে আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল হয়ে নবীনগর মোড় এবং ইপিজেড হয়ে চন্দ্রা মোড়ে শেষ হবে। উড়াল সড়কের মোট দৈর্ঘ্য হবে ২৪ কিলোমিটার। উড়াল সড়কের মধ্যে আরো থাকবে ১০ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ র্যাম্পস, ১ দশমিক ৯২ কিলোমিটার দু’লেনের নবীনগর ফ্লাইওভার নির্মাণ, উড়াল সড়কের উভয় পাশে চার লেনবিশিষ্ট মোট ১৪ দশমিক ২৮ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, ২ দশমিক ৭০ কিলোমিটার দু’লেন সেতু নির্মাণ, ৫শ’ মিটার ওভারপাস বা ফ্লাইওভার নির্মাণ, ১৮ কিলোমিটার ইউটিলিটির জন্য ড্রেনেজ এবং ডাক্ট নির্মাণ, পাঁচটি টোলপ্লাজা।

খরচের হিসাব থেকে দেখা গেছে, প্রতি হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণে ৬৭ কোটি ২১ লাখ টাকা হিসাবে মোট ব্যয় দুই হাজার ৭৪৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ৩৫১ কোটি টাকা হিসাবে মোট ব্যয় ২৪ কিলোমিটারে আট হাজার ৪২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রতি কিলোমিটার র্যাম্পস তৈরিতে ৪৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা ধরে মোট ১০.৮৪ কিলোমিটারে খরচ ৫৩৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ১.৯২ কিলোমিটার দু’লেনের ফ্লাইওভারে প্রতি কিলেমিটারে ৯৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা ধরে মোট ব্যয় ১৮৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। চার লেনের সড়ক পুনঃনির্মাণ কিলোমিটারে ৪৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা হিসাবে ১৪.২৮ কিলোমিটারে ৬৮৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রতি কিলোমিটার ড্রেন ও ডাক্ট নির্মাণে প্রায় পৌনে ১৫ কোটি টাকা ধরে মোট ব্যয় ১৮ কিলোমিটারে ২৬৫ কোটি চার লাখ টাকা। ৬৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরে চারটি টোলপ্লাজায় খরচ ২৫৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আর পরামর্শক সেবায় ৩০১ কোটি ১০ লাখ টাকা।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে দুই দেশের মধ্যে বিনিয়োগ শক্তিশালী এবং উৎপাদন দক্ষতায় সহযোগিতার আওতায় স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে এই প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে এখনো ঋণচুক্তি হয়নি। গত ১২ মার্চ চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পাদিত নেগোসিয়েটেড প্রাইসের পুরোটাই প্রকল্প সাহায্য হিসেবে ডিপিপিতে দেখানো হয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র জানায়, মোট ব্যয়ের ৮৫ শতাংশ চীন সরকারের জিটুজি ঋণ এবং ১৫ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে। চীনা অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পে সাধারণত এই নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। প্রকল্পে ইন্টারেস্ট ডিউরিং কনস্ট্রাকশন বা নির্মাণকালীন সুদ বাবদ মোট এক হাজার ৩১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে কোনো ধরনের গ্রেসপিড়িয়ড বিবেচনায় না নিয়ে নির্মাণকালীন সময়ে পুরো ঋণের সুদ পরিশোধ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

প্রকল্পের সর্বশেষ পরিস্থিতির ব্যাপারে গতকাল মুঠোফোনে জানতে চাইলে প্রকল্পের উপপরিচালক এস এম লাবলুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বাস্তব অগ্রগতি আছে, কাজ হয়েছে, কিন্তু ঋণচুক্তি যে দিন থেকে কার্যকর হবে সে দিন থেকেই আমরা বলতে পারব কতটা বাস্তব কাজ হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এটা জুনেই আমরা ঘোষণা করতে পারব। তিনি বলেন, যারা কাজ করছে তারা নিজেদের ফান্ডেই কাজ করছে। ঋণচুক্তি কার্যকর শুরু হলেই ওরা আমাদের কাছে অর্থ দাবি করতে পারবে। আমরাও তখন তাদেরকে টাকা পরিশোধ করতে পারব।

নির্মাণকালীন ঋণের সুদ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই এক হাজার ১১৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) পরিশোধ করবে। ওটা এ খরচের মধ্যে পড়ছে না বলেই এই সংশোধনীতে বাদ দেয়া হয়েছে।

আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি সমাপ্ত হবে কি না জানতে চাইলে এই উপপরিচালক বলেন, আশা করি সেটি আমরা সমাপ্ত করতে পারব। মূলত ঋণচুক্তি কার্যকর হওয়ার কারণেই বিলম্ব।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/666628