৩০ মে ২০২২, সোমবার, ১১:২৭

পদ্মার তলদেশ ভরাট হয়েছে ৭ ফুট

সরদার আবদুর রহমান: গত চার দশকে ফারাক্কার প্রতিক্রিয়ায় পানির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বাংলাদেশে পদ্মার তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে ৭ ফুটের বেশি। বর্তমানে বয়ে যাওয়া বাংলাদেশ অংশের গঙ্গার বা পদ্মার এখন আর সে ক্ষমতা নেই পূর্বের মতো বিশাল পরিমাণ পানি ধারণ করে রাখার।

উজানে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশ অংশের গঙ্গার তলদেশে পলি ও বালি জমে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নদীর কোনো কোনো অংশে এই জমে থাকা পলিতে নানাপ্রকার ফসল আবাদ হওয়ায় একে “ফসলি জমি উদ্ধার” হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন কোনো কোনো মহল। কিন্তু পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন উল্টোটা। তাঁদের মতে, নদীকে বিবেচনা করতে হবে তার পানির প্রবাহ, আয়তন ও পানির গভীরতা দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ অংশের গঙ্গা-পদ্মার অবস্থান সেই জায়গায় নেই। ফারাক্কার কারণে উজানের দেশ বাংলাদেশের গঙ্গা-পদ্মার যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে এখানকার কৃষি-সেচ, যাতায়াত-যোগাযোগ, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ-প্রকৃতি সর্বোপরি অর্থনীতি চরম হুমকির মুখে পড়ে গেছে। এখন পর্যন্ত জানা তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের বন্যায় গঙ্গার বাংলাদেশ অংশ দিয়ে সর্বোচ্চ ১৮ লক্ষ কিউসেক পানি প্রতিদিন প্রবাহিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ জানাচ্ছেন, পানির পরিমাণ যদি আরো সামান্য বৃদ্ধি পায় তবুও গঙ্গা সর্বোচ্চ ২২ লক্ষ কিউসেক পানি ধারণ করতে সক্ষম। ফারাক্কা তৈরির আগে বন্যার সময় ২৫ লাখ কিউসেক পানি প্রবাহিত হতে পেরেছে।

নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে শুধু খরা মওসুমেই বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে না, বর্ষা মওসুমে ভারতীয় অংশে বাড়তি পানির চাপ মোকাবেলায় ফারাক্কার গেটগুলো একযোগে খুলে দিয়েও আকস্মিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ। নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী মনে করেন, হঠাৎ করেই ফারাক্কার সবকটি গেট কোনো পূর্ব আলোচনা ব্যতিরেকেই খুলে দিয়ে আমাদের জন্য যে আতংকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়ে থাকে সেটি আসলেই অকল্পনীয় এবং অনাকাক্সিক্ষত। যদিও আমাদের প্রকৌশলী এবং বিশেষজ্ঞেরা বার বার আশ্বস্ত করেছেন যে, ‘ফারাক্কার সব কটি গেট খুলে দিলেও যেটুকু পানি ভাটিতে প্রবাহিত হবে, এতে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না।’ কথাটি শুনতে ভাল শোনালেও কিন্তু উজানে অতিরিক্ত বন্যা দেখা দিয়ে মাঝেমধ্যেই গঙ্গার অতিরিক্ত পানির তোড়ে তলিয়ে যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, মানিকগঞ্জ এবং মুন্সিগঞ্জের অসংখ্য গ্রাম ও জনপদ। ভেঙে পড়ে শত শত একর আবাদি উর্বর জমি। এখন অবধি গঙ্গার পানির হাল নাগাদ যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, উজানে (মালদা-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল) হঠাৎ করেই বন্যা দেখা দিলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাদের জানমাল বাঁচানোর তাগিদে ফারাক্কার শতাধিক গেট (১০৪টি) খুলে দিয়ে থাকে। ফারাক্কার সবকটি গেট খুলে দিলে এই বন্যায় পানি আসবে তের লক্ষ কিউসেক। এই পরিমাণ বাড়তেও পারে। বাংলাদেশের গঙ্গার এই পরিমাণ পানি ধারণ করার ক্ষমতা এখন অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলেছে। আর ফারাক্কার উজানে বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখন্ড রাজ্যে গঙ্গার উপনদীগুলোর মুখে যে অসংখ্য বাঁধ রয়েছে- এগুলো খুলে দিলে বাংলাদেশের অবস্থা হবে সত্যি সত্যিই মহাবিপর্যয়কর।

মাহবুব সিদ্দিকী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ বি. এম আব্বাস (মরহুম) বহুদিন পূর্বেই বলেছিলেন- ফারাক্কা বাঁধ ভবিষ্যতে ভারতের জন্য হবে বিপদের কারণ, হয়েছেও তাই। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার ইতোমধ্যেই ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার পক্ষে খোলাখুলি মতামত রেখেছেন। তার বক্তব্য- ফারাক্কার কারণে বিহার অঞ্চলের গঙ্গায় তলদেশ ভরাট হতে চলেছে। এর ফলে প্রতি বছর বিহারে বন্যা দেখা দিচ্ছে। ভারতের একশ্রেণির বিশেষজ্ঞ ফারাক্কার কারণে ভারতীয় এলাকায় একটি পৃথক ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে বলে আত্মতৃপ্তি খুঁজছেন। কিন্তু এতোদিন গঙ্গার অধিকাংশ পানি অনৈতিকভাবে প্রত্যাহার করে নিজেদের প্রকৃতি ও পরিবেশকে সতেজ করে থাকলেও অপরদিকে বাংলাদেশ অংশের ইকোসিস্টেম কোন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে- এবিষয়ে তারা নীরব রয়েছেন। এটাই হয়তো তাদের কাছে স্বাভাবিক। উজানের দেশ একে একে সবকয়টি নদ-নদীর পানি এক তরফাভাবে প্রত্যাহার করে সবুজ শ্যামল কাননময় এই দেশটিকে মরুময়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আবার মাঝে মধ্যে বন্যার তা-ব থেকে নিজেরা রক্ষা পাবার জন্য কোন আগাম বার্তা না দিয়েই অতিরিক্ত পানি ছেড়ে ভাটির বাংলাদেশকে মহাবিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলেও মাহবুব সিদ্দিকী মনে করেন।

https://dailysangram.com/post/490708