২৯ মে ২০২২, রবিবার, ৭:২৭

বিরোধীদের চাপে রাখতে হামলা-মামলা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, স্বাধীনভাবে রাজনীতি করার পরিবেশ সৃষ্টি, নির্বাচনকালীন সময়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, ইভিএম বাতিল করে জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবিই এখন সবার প্রত্যাশা। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা সেটি না করে কিভাবে আবারো জোর করে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা যায় সেটি নিয়েই ব্যস্ত। এমনটিই মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, নির্বাচনের আগে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি তথা নিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা করা, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, সবার জন্য সভা-সমাবেশের ব্যবস্থা করা এসবই এখন মূল কাজ। সরকারের এসবে মনোযোগ নেই। তারা ব্যস্ত বিএনপিসহ বিরোধী জোটকে নানা ইস্যুতে ব্যস্ত রাখা নিয়ে। যাতে করে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে না পারে। একইসাথে জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরানো যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে আতংক ও ভীতি ছড়িয়ে দেয়া। যাতে করে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে নামতে না পারে। বিরোধীদের বেশ চাপে রাখার চেষ্টায় সম্প্রতি ঢাবিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীনদের হামলার চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এছাড়া বিএনপিসহ বিরোধীদের বিুরদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলাগুলো আবারো সচল করা, খালেদা জিয়ার জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধি না করা, আবারো গণগ্রেফতারের পাশাপাশি নতুন মামলা দেয়ার আয়োজন শুরু হয়েছে। এসব নিয়ে বিএনপিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও এবার মাঠ না ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তবে বিএনপির এমন ঘোষণায় পুরোদস্তুর মাঠ দখলে রাখারা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছেন, বিশৃঙ্খলা করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

এরই মধ্যে ঢাবির ঘটনায় নিজেরা হামলা চালিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বলছেন, দিন যতই যাচ্ছে ততই সংকট বাড়াচ্ছে দেশের সবচেয়ে পুরাতন দল আওয়ামী লীগ। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, যেকোন সময় সরকারের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ঘটতে পারে। বিরোধী দলের আন্দোলনের জন্যও তারা অপেক্ষা করবেনা। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে যেভাবে জনগণের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে, সেটি যে কোনো সময় ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এছাড়া বিরোধী জোটের আন্দোলন ঘোষণায় ভীত সন্ত্রস্ত দলটি। এরই মধ্যে বিএনপি মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ঘোষণা দিয়েছেন, এই সরকারের পতন ঘটিয়েই তারা ঘরে ফিরে যাবেন।

সূত্র মতে, বর্তমান সরকার এখন চতুর্মুখী সংকটে পড়েছে। প্রশাসনিক ও দলীয় সংকটের পাশাপাশি কূটনৈতিক সমস্যাও দানা বেঁধে উঠছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা, প্রতিবেশী ভারতসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন রাশিয়ানহ বহির্বিশ্বও বলে দিয়েছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে তারা আগের অবস্থানে নেই। তারা চান একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সব মিলিয়ে সরকারের ভেতরের অবস্থা অনেকটাই নাজুক।

সূত্র মতে, দেশে-বিদেশে যখন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি ক্রমশ: জোরালো হচ্ছে তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত। তারা বিরোধী মতকে নানাভাবে হেনস্তার পাশাপাশি ব্যস্ত রাখার অপকৌশল হাতে নিয়েছে। দেশে যখন সবাই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা করছে তখন সরকার হঠাৎ করেই হামলা-মামলার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। খালেদা জিয়ার জামিন না বাড়িয়ে তাকে আবারো কারাগারে পাঠানোর হুমকি দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী খালেদা জিয়াকে আবারো কারাগারে পাঠানো হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। আ’লীগের এই নেতারা অতীতের ন্যায় এবারো বলেছেন, সংবিধান মেনেই তথা ক্ষমতাসীনদের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটা নিয়ে বিরোধীদের পানি ঘোলা করতে দেয়া হবে না। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপি বা বিরোধী জোটের সাথে আলোচন কোনো প্রয়োজন নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারা কি করবে বুঝতে পারছেনা। একেক সময় একেক ইস্যু তৈরি করে বিরোধী জোটকে ব্যস্ত রাখতে চাইছে। একইসাথে জনগণের দৃষ্টিকেও অন্যদিকে সরাতে চাইছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার মূল ফোকাস থেকে দৃষ্টি সরাতে এসব ইস্যু তৈরি করছে। তবে সরকারের শেষ রক্ষা হবেনা বলেই মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

সূত্র মতে, একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলই এখন সক্রিয়। বিদেশীরা একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের চাপ দিচ্ছে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে নিজ নিজ রাজনৈতিক সমীকরণে গন্তব্যে পৌঁছাতে সবাই বহুমুখী তৎপরতা জোরদার করছেন। ক্ষমতাসীনদের লক্ষ্য- টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। আর তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চাচ্ছে সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা নানা বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে মূল যে বার্তাটি দিচ্ছেন তা হলো, বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরেই নির্বাচন হবে। সেক্ষেত্রে কে নির্বাচনে আসলো কে আসলো না সেটি ধর্তব্য নয়। এই অবস্থানে অটল থেকে সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আনুষঙ্গিক সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। তারই অংশ হিসেবে তারা বিরোধী জোটকে নানাভাবে ব্যস্ত রাখতে চাইছে। একের পর এক ইস্যু তৈরি করে কয়েকটি মাস অতিক্রম করতে চায় তারা।

তবে সরকারপক্ষের এই অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে বিএনপিসহ তাদের রাজনৈতিক মিত্র-বলয়। সংসদ ভেঙে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে সচেষ্ট এই পক্ষ। তাদের দাবির মূল কথা হচ্ছে, নির্বাচনের প্রতিযোগিতা হতে হবে সমতল মাঠে। বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া এবং নিরপেক্ষ সরকার ব্যতীত দেশে কোনো নির্বাচন হবেনা। এই সরকার অবৈধ। তাই দ্রুত সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারকে ক্ষমতা দিতে হবে। তাদের অধীনেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এসব দাবিতে বিএনপি ইতিমধ্যে সরকারবিরোধী দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু করেছে। নির্বাচন ও ঐক্যবদ্ধ যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা নিয়েই মূলত এই সংলাপে আলোচনা হচ্ছে। সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা শেষে নিরপেক্ষ সরকারসহ বিভিন্ন দাবিতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ও আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেেব বিএনপি।

জানা গেছে, নির্বাচনে আগে বিএনপিকে ব্যস্ত রাখতে সরকার যে কৌশল নিয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে গণগ্রেফতার, যেখানেই সভা সমাবেশ, সেখানেই বাধা-হামলা মামলা। পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাদের সহায়তা করবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া বিরোধী দলগুলোকে ব্যস্ত রাখতে পুরনো মামলাগুলোকে সচল করছে সরকার। এর মাধ্যমে নেতাকর্মীরা আদালতের বারান্দায় সময় পার করবে অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবে। এই কৌশলেরই অংশ হিসেবে অসংখ্য মামলায় জড়িয়ে রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের মূল নেতাদের। আওয়ামী লীগ যখন সাংগঠনিক ও নির্বাচনী তৎপরতা জোরদার করছে তখন বিএনপিজোটের নেতাদের ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে আদালতে। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এখনো গৃহবন্দী। তার মুক্তি ও চিকিৎসা নিয়ে সরকার নানা অপকৌশল করছে বলে বিএনপির অভিযোগ। কথিত মামলায় হাজিরা দিতে গেলে নেতাকর্মীদের ফের গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। জড়ানো হচ্ছে নতুন নতুন মামলায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধীদের রাজনৈতিক ময়দান থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সবরকম কৌশল-অপকৌশল প্রয়োগ করে আসছে। সেই থেকে এযাবৎ দেশের সর্বত্র বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের উপর হামলা, মামলা, গুম, খুন প্রভৃতি দমনমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে।

বিশেষ করে একেকজন নেতা-কর্মীকে কাবু করার জন্য মামলা দায়ের করাকে এক ‘মোক্ষম’ হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার মূলত তাদের দুর্নীতি, লুটপাট, দখল, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে ব্যর্থতাসহ অপশাসনের বিষয়গুলো আড়াল করতেই নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।

জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনের এখনো বেশ কয়েক মাস বাকি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যা করার তা সবই সরকারকে করতে হবে। নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে সব দলকে প্রচারের সুযোগ দিতে হবে। নিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সবাইকে আস্থায় নিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটি দেখা যাচ্ছেনা। এখন সরকারি দল ও বিরোধী জোট দুই মেরুতে অবস্থান করছে। তবে পরিবেশ তৈরি করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে এবং সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘরে ফিরবে না। বিএনপি কোনো ব্যক্তি বা দলকে ক্ষমতায় বসাতে নয়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলনে নেমেছে।

বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, গণ-আন্দোলনের রঙিন স্বপ্ন দেখছে বিএনপি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও অর্জনে বিএনপির আন্দোলনে সংকটের কালো ছায়া পড়েছে। তাদের গণআন্দোলন স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নের নামান্তর। এই দুঃস্বপ্ন দেখে কোনো লাভ আছে কী? গণ-আন্দোলনের নামে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টা করছে বিএনপি।

জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতিকে চরম সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা করে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষার বয়ান দিয়ে রাজনীতিতে সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। এসবের মাধ্যমে সরকার নিজের পতনকে ত্বরান্বিত করছে কেবল।

আক্রমণের শিকার হলে পাল্টা আক্রমণ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আক্রমণের বিপরীতে পাল্টা আক্রমণ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। মাইর খাওয়া একমাত্র কাজ নয়। রক্ত দিয়ে প্রতিবাদের খাতায় নাম লেখালে হবে না। জনগণের বিপক্ষে কথা বললে প্রয়োজনে কারো রক্ত দিয়ে বাধা দিতে হবে। পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে তাদের প্রতিহত করতে হবে।

https://dailysangram.com/post/490629