২৯ মে ২০২২, রবিবার, ৭:২৪

যে কাউকে আক্রমণের অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে

-আসিফ আরসালান

কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে তার দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের প্রতি এই মর্মে আহ্বান জানিয়েছিলেন যে এখন থেকে (অর্থাৎ ঐ বৈঠকের দিন থেকে) বিরোধী দলকে সভা-সমিতি করার স্বাধীনতা দেয়া হবে। তাঁর নেতাকর্মীদের প্রতি তিনি এই মর্মে আহ্বান জানান যে, তারা যেন বিরোধী দলের সভা সমিতিতে বাধা না দেয়। প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বানে রাজনীতি সচেতন মানুষ খুশি হয়েছিলেন। দেশ এমনিতেই হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি দ্রব্যসামগ্রীর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সরকার যতই জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা বলুন না কেন, বাজারে গেলে পকেট খালি হয়ে যায় এবং বাজারের যে ফর্দ মানুষ নিয়ে যায়, অর্থের অভাবে ফর্দের সব কটি পণ্য কেনা হয় না। নি¤œবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

এমন একটি টানাটানির সংসারে এবং টানাটানির সমাজে যখন সরকার সভা সমিতি, মিছিল মিটিং করায় বাধা দেবেন না বলে আশ্বাস দেন তখন মানুষ অন্তত একটা দিকে স্বস্তি বোধ করেন। ভাবেন যে তাদের অভিযোগ এবং দুঃখ দুর্দশার কথা তো বলা যাবে।

প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ প্রধানের ঐ আশ্বাসের পর এক মাসও যায়নি। ছাত্রলীগ আবার চন্ড নীতিতে ফিরে এসেছে। গত শুক্রবার ২৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল একটি মিছিল বের করেছিল। এটি কোনো সরকার বিরোধী মিছিল বা বিক্ষোভও ছিল না। সরকারের, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে যে তাদের ভয়ে তটস্থ ছাত্রদল মিছিলে একটি স্লোগানও দেয়নি। তৎসত্ত্বেও ছাত্রলীগ মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘দৈনিক প্রথম আলোর’ রিপোর্ট মোতাবেক ছাত্রদলের মিছিলে হামলা চালিয়ে ছাত্রদলের অন্তত ৩০ জনকে ‘পিটিয়ে রক্তাক্ত’ করে। ছাত্রদলের মোট ৮০ জন সদস্য এই হামলায় আহত হন।

২৪ মে মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে ছাত্রদলের একটি সাংবাদিক সম্মেলনের কর্মসূচি ছিল। সকাল সাড়ে ১০ টায় এই সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সাংবাদিক সমিতির অফিসটি টিএসসির দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত। কথা ছিল, ছাত্রদলের নেতা কর্মীরা সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে জড়ো হবেন। অতঃপর তাঁরা মিছিল করে সাংবাদিক সমিতির অফিসে যাবেন এবং পূর্ব নির্ধারিত সাংবাদিক সম্মেলন করবেন।

এই কর্মসূচি অনুযায়ী তারা ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের সামনে জড়ো হয়ে একটি মিছিল সহযোগে সাংবাদিক সমিতি অফিসের দিকে যাত্র শুরু করেন। মিছিলটি শহীদ মিনার পার হওয়ার আগেই ছাত্রলীগের ক্যাডাররা লাঠি সোঁটা এবং দেশীয় অস্ত্র সহযোগে মিছিলের ওপর হামলা চালায়।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ প্রধানের আশ্বাস এবং পরদিন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভালো ভালো কথায় বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি ও ছাত্রদল মনে করে যে আর হামলা হবে না। ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিরোধী দলের ব্যাপারে নেত্রী বলেছেন, তারা মিছিল, মিটিং, সমাবেশ করুক। তারা স্বাধীনভাবে করুক। আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করার প্রয়োজন নাই।” উল্লেখ্য, গত ৭ মে গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ঐ আশ্বাস বাণী দেন এবং তারপর ওবায়দুল কাদের ঐ সব ভালো ভালো কথা বলেন। তার মাত্র ১৬ দিন পর ঢাকা ভার্সিটিতে এই হামলার ঘটনা ঘটলো।

॥ দুই ॥

ছাত্রলীগ ছাত্রদলের ওপর শুধুমাত্র ২৪ মে মঙ্গলবারই হামলা করেনি। এর আগের দিন, অর্থাৎ ২৩ মে সোমবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের ওপর এবং একই দিন সিলেট আলিয়া মাদরাসাতেও ছাত্রলীগ হামলা চালায়। এসব হামলাকে ছাত্রলীগ ‘প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ’ হিসাবে চালিয়ে দেয়। প্রতিপক্ষের সভা সমাবেশ মিছিলে হামলা এবং হামলার পর ‘রুদ্র জনতার ক্ষোভ’ বলে চালিয়ে দেয়া আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের বহু ব্যবহৃত পুরাতন কৌশল। পাকিস্তান আমলে তারা ঢাকার সদরঘাটের অদূরে অবস্থিত রূপমহল সিনেমা হলে মওলানা ভাসানীর সম্মেলনে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছিল। পরদিন পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী, খান আব্দুল গাফফার খান, মিঞা ইফতিখারুদ্দিন প্রমুখের জনসভায় প্রচ- হামলা চালিয়ে সেই বিশাল জনসভা সম্পূর্ণ প- করে দিয়েছিল এই আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। পল্টনে প্রখ্যাত আইনজীবী এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খানের জনসভাতেও হামলা হয়েছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আজকের সিপিবি নেতা মুজাহিদুল ইসলাম ছিলেন ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি এবং মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭৩ সালের ১ লা জানুয়ারি ভিয়েতনামে মার্কিনী বর্বরতার বিরুদ্ধে ডাকসু ও ছাত্র ইউনিয়নের একটি প্রতিবাদ মিছিল ভার্সিটির আমতলা থেকে বের হয়। মিছিলটি সেগুনবাগিচায় প্রেসক্লাবের ঠিক বিপরীত দিকে মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সামনে এলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং মতিউল ও কাদের নামে ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতা মারা যান। পরদিন আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ ছাত্র ইউনিয়নের ওপর সাঁড়াশী আক্রমণ চালায়। উপরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের যতগুলি হামলার কথা বললাম তার সবগুলিকেই ‘রুদ্র জনতার ক্ষুব্ধ প্রকাশ’ বলে চালানো হয়।

২৪ মে বেগম জিয়ার প্রতি কটাক্ষ এবং ছাত্রদল সভাপতি রওনকুল ইসলামের ওপর হামলার প্রতিবাদে মুন্সীগঞ্জে আয়োজিত ছাত্রদলের সমাবেশ পুলিশী বাধার মুখে প- হয়ে যায়। এই সমাবেশে পুলিশের লাঠি পেটায় মুন্সীগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মোজাম্মেল হকসহ অন্তত: ৬ জন আহত হয়েছেন বলে ২৫ মের প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্য অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়ার শামিল। তিনি বলেন, যারা রাস্তায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, ভাংচুর করে, জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ায় কিংবা মানুষের যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হস্তক্ষেপ করে। ছাত্রলীগ পরিকল্পিতভাবে ছাত্রদলের ওপর হামলা করেছে। এমন অভিযোগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এগুলো বিরোধীদের প্রচারণার কৌশল।

॥ তিন ॥

যে পেশী শক্তির উলঙ্গ প্রকাশ ঘটিয়েছে ২৩ মে, সেই পেশী শক্তি সঞ্চালন অব্যাহত রেখেছে ছাত্রলীগ ২৬ মে পর্যন্ত। ২৬ মে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ঢুকে ছাত্রদলের নেতাদের বেধড়ক পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। দৈনিক মানবজমিনের রিপোর্ট মোতাবেক একজন সাংবাদিকসহ ২০ জন ছাত্রদল কর্মী আহত হয়েছেন। ছাত্রদল হাইকোর্ট এলাকা থেকে শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে দোয়েল চত্বরের দিকে এগুতে থাকে। তারা কোনো উত্তেজক শ্লোগানও দেয়নি। ছাত্রদলকে পেটানোর জন্য ছাত্রলীগ আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়। ছাত্রদলের মিছিল দেখামাত্র তারা হামলা চালায়।

মানবজমিনের অপর খবরে প্রকাশ, একই সময় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ‘ডেইলি ক্যাম্পাসের’ সাংবাদিক আবির আহমেদকে বেধড়ক পেটায়। ২৬ মে মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণের খবরে প্রকাশ, ঐ দিন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হাইকোর্ট ভবনের অভ্যন্তরে ঢুকে হামলার ছবি তোলার অপরাধে আইনজীবীদের ওপরও হামলা চালায়। এ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারসহ একাধিক আইনজীবীর গাড়ি ভাংচুর করে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, সহিংসতার উদ্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেই ছাত্রদলকে প্রতিহত করা হবে। এর অর্থ হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি তাহলে ছাত্রদলকে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করলো? ছাত্রদলের ছেলে পেলেরা ভার্সিটিতে ঢুকলেই কিভাবে বোঝা যাবে যে ওরা সহিংসতার জন্য ঢুকেছে? ওদের পিঠে বা বুকে কি সহিংসতার ছাপ মারা থাকবে? এই সব ঝুটা ইলজাম দিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করেছে।

ছাত্রলীগের শ্বেত সন্ত্রাস ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। ২৬ ডিসেম্বর দৈনিক সমকালের অনলাইন সংস্করণের খবরে প্রকাশ, খুলনায় বিএনপি নেতা কর্মীদের সাথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ এবং ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় খুলনা বিএনপির সদস্য সচিব শরিফুল আলম তুহিনসহ ২০ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫০ জন আহত হয়েছেন।

ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিস্তারিত বয়ান দিতে গেলে একটি মহাকাব্য রচনা করতে হবে। ছাত্রলীগের একজন সিনিয়র কর্মীকে সালাম না দেয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জুনিয়র ছাত্রকে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার রাত ১২ টায় সূর্যসেন হলে। পিটিয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মানিকুর রহমান মানিক। যাকে পেটানো হয়েছে সে হচ্ছে নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সাজ্জাদুল হক সাঈদী।

ছাত্রলীগের এই ভয়াল সন্ত্রাসী রূপের বিরুদ্ধে বিগত ১৩ বছর হলো অনেক লেখালেখি হয়েছে। অনেক বক্তব্যও রাখা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই ছাত্রলীগের সন্ত্রাস থামাতে পারেনি। প্যারেন্ট সংগঠন বা ঊর্ধ্বতন মহলের মদদ ছাড়া ছাত্রলীগ কি এমন বেপরোয়া হতে পারে? প্রথম আলোর সম্পাদকীয় কলামের শিরোনাম, “বিরোধী দলের কি কর্মসূচির অধিকার নেই?” ডেইলি স্টারের এডিটোরিয়ালের শিরোনাম, “What gives BCL the right to attack anyone? / DU mayhem puts it at odds with PM’s directive.’’ বাংলা অনুবাদ: “যে কাউকে আক্রমণের অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিংসতা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরিপন্থী।”

Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/490580