২৮ মে ২০২২, শনিবার, ১০:৫১

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

মেলে না আয়-ব্যয়ের হিসাব

মো. মিলন ও কলি বেগম। রাজধানীর মাদারটেক বাজারে এসেছেন কেনাকাটা করতে। কলির কোলে আড়াই বছরের শিশু। মিলনের হাতে বাজারের ব্যাগ। তারা মাছের বাজার ঘুরে দেখছেন আর দরদাম করছেন। একটি বড় ইলিশ মাছের দিকে চোখ গেল মিলনের। বিক্রেতার কাছে দাম জিজ্ঞেস করলেন। ১২০০ টাকা কেজি দাম হাঁকালেন। শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন তারা। কারণ এত টাকা দিয়ে ইলিশ মাছ কেনার সাধ্য নেই পরিবারটির।

তাই দু’দণ্ড না দাঁড়িয়ে অন্য বিক্রেতার কাছে চলে যান। সেখানে দর কষাকষি করে ১৫০ টাকার চিংড়ি মাছ কিনলেন। পেলেন ২৫০ গ্রাম। মিলন বলেন, ছেলে চিংড়ি মাছ খেতে চাইছে। তাই ১৫০ টাকার চিংড়ি কিনলাম। আমাদের তো ইলিশ মাছ কেনার ক্ষমতা নাই।

মিলন দিনমজুর। সাত বছর ধরে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। দৈনিক বেতন পান ৭০০ টাকা। মাসে তার ২৫-২৬ দিন কাজ হয়। এতে সাড়ে ১৭ হাজার টাকার মতো আয় হয়। তবে বৃষ্টির দিনে অথবা কাজ না থাকলে তার এই আয় নেমে যায় ১৪-১৫ হাজারে। এই উপার্জনে তার সংসার টানাপোড়নের মধ্যে চলে। মিলন থাকেন সবুজবাগ থানার মাদারটেক উত্তর পাড়ায়। পরিবারে তার স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট ছেলে তৃতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। আর মেয়ের বয়স ৩ বছর। সন্তানের লেখাপড়া, সংসার খরচসহ অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে কোন সঞ্চয় করতে পারে না পরিবারটি। মিলন বলেন, আমার সঞ্চয়- ছেলেমেয়ে। ওদের লেখাপড়া করাইতাছি। ওরা বড় হইলে যদি কামাই করতে পারে তাইলে এটাই হইবো আমার সঞ্চয়।

মিলন জানান, ছোট একটি সাবলেট বাড়িতে থাকেন তারা। একরুমের জন্য মাসে ৪ হাজার টাকা ঘরভাড়া দিতে হয়। বাজার খরচ ১০-১২ হাজার টাকা। দু’টি খাতেই তার ১৪-১৬ হাজার টাকা খরচ হয়। তবুও দামি মাছ কিংবা গরুর মাংস কিনে খাওয়ার জো নেই। এছাড়া ডিস, ইন্টারনেট, মোবাইল বিলসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে মাসে আরও দুই হাজার টাকা খরচ হয়। এরপর ব্যয় মেটানোর মতো আয়ের কোনো অর্থই হাতে থাকে না। অথচ দুই সন্তানের লেখাপড়ার জন্য মাসে আরও তিন হাজার টাকা খরচ হয় পরিবারটির। তখন আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারেন না মিলন। বাধ্য হয়ে মিলনের স্ত্রী কোলি ঘরে দর্জির কাজ করেন। এতে তিনি মাসে ৩-৪ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। এই টাকা দিয়েই সন্তানের পড়ালেখার ব্যয় মেটায় পরিবারটি।

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রতিদিনই তাদের ব্যয় বাড়ছে। দু’জনের উপার্জনেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। তাই চাল, ডাল, তেল কেনার পর কেবল কমদামি সবজি আর আলুই ঠাঁই পাচ্ছে খাবার তালিকায়। ইচ্ছা হলেও মাসে একবার গরুর মাংস কিংবা ইলিশ মাছ কিনে খাওয়ার জো নেই। কোলি বলেন, এখন দাম অনেক বেড়েছে। আগে ইনকাম কম থাকলেও জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। সংসার চলছে। এখন বাজারে দাম বেশি তাই কম ইনকামে চলে না সংসার। ঘর থেকে হিসাব করে বাজারে আসি। তাও অনেক সময় দামের সঙ্গে মিলে না। অনেক কিছু কিনতে পারি না। পরিবারের কর্তা মিলন বলেন, ঈদে গরুর মাংস কিনছিলাম। হে ছাড়া আর কেনা হয় না। গরুর মাংস কিনতে গেলে ঘরভাড়া দেয়া সমস্যা হইয়া যায়। এখন দাম বাড়ার জন্য খাওয়া কমাই দিছি। আগে মুরগি ছিল ১৩০ টাকা কেজি। এহন ১৭০ টাকা। ১৫ দিন পর একবার খাওয়া হয়। আজকে চিংড়ি মাছ কিনলাম ১৫০ টাকা দিয়া। ডাল রান্না করতাছে। একটা সবজি কিনতে ৫০ টাকা লাগবো। চাল কিনতে ৬০ টাকা লাগবো। আর তেল-মশলা তো আছেই। তাতেই ৩০০ টাকা খরচ হইয়া যাইব একদিনে।

জুনায়েদ মাশরিকি টেক্সটাইলের ছোট একটি ব্যবসা করেন। সেখান থেকে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। পরিবার নিয়ে থাকেন মাদারটেক চৌরাস্তার একটি বাড়িতে। সেখানে তার ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল বাবদ ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। পরিবারে স্ত্রী ও এক সন্তান রয়েছে। সন্তানের লেখাপড়ার জন্য মাসে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। বাকি ১০ হাজার টাকাতে তার বাজার ও আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে হয়। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিনকে দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে পরিবারটি। জুনায়েদ বলেন, আয়ের সঙ্গে আমাদের ব্যয়ের সামঞ্জস্য নাই। এখন জীবন চালানো কঠিন হয়ে গেছে। তারপরও কোনো ভাবে চলতে হচ্ছে।

যেখানে আগে বেশি বাজার করতাম তা এখন কমানো হচ্ছে। ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে সবকিছু কিনতে হচ্ছে। এখন প্রত্যেকটা জিনিসের দাম প্রায় দ্বিগুণ। অথচ আমাদের বেতন দ্বিগুণ হচ্ছে না। এজন্য আমরা আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে পারছি না। বর্তমানে সংসার নিয়ে চলাফেরা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে তাদের মতো অনেকেই নাভিশ্বাস ফেলছেন। কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে জীবন চালাচ্ছেন। সংসার চালাতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন। কাটছাঁট করছেন খাদ্য তালিকা।

https://mzamin.com/news.php?news=4916