২৮ মে ২০২২, শনিবার, ১০:৩৯

ভারত-মিয়ানমার থেকে আসছে উচ্চমূল্যের ভয়ঙ্কর মাদক

প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ২৪ ধরনের মাদক আসছে বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই আসে মিয়ানমার থেকে। সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আসা এসব মাদক ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এক বছরে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত থেকে কোটি কোটি পিস ইয়াবা আসছে ঢাকায়। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকায় তা ছড়িয়ে পড়েছে। মাদক নির্মূলে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের মধ্যেও থেমে নেই ইয়াবা ব্যবসা। শুধু ইয়াবাই নয়- সীমান্ত থেকে আসা চালানের মধ্যে রয়েছে উচ্চ মূল্যের ভয়ঙ্কর মাদক ‘এলএসডি’ ও ‘আইস’। সহজলভ্য হওয়ায় এসব মাদকে আসক্ত হয়ে তরুণ-যুবকরা অপরাধে জড়াচ্ছে। বেড়েছে খুন, ডাকাতি-ছিনতাই চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ এর (বিজিবি) এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মাদক রোধে কঠোর হতে কঠোরতর হতে হবে। অপরাধীদের কোনো দলীয় পরিচয় নেই। মাদকের সঙ্গে জড়িতরা যে দলেরই হোক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী-শুধু ঢাকা বিভাগেই সাড়ে তিন হাজার সন্দেহভাজন মাদক কারবারীর তালিকা রয়েছে তাদের হাতে। কর্মকর্তারা বলেছেন, যাদের চিহ্নিত করে এই তালিকা করা হয়েছে, তাদের নজরদারিতে রেখে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২০ সালের তুলনায় এখন সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে কয়েকশ সন্দেহভাজন নিহত হয়েছে। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, মাদক ব্যবসায় গডফাদার এবং প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, মূলত সে কারণে অভিযানে কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় ঢাকা বিভাগে সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল তিন হাজার। ২০২১ সালের তালিকায় সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাড়ে তিন হাজার।

জানা গেছে, একসময় দেশের মাদকের তালিকায় গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার আধিপত্য থাকলেও সম্প্রতি বিস্তার ঘটছে আলোচিত ক্ষতিকর মাদক আইস (মেথামফেটামিন) বা ক্রিস্টাল মেথের। বিভিন্ন সংস্থা ও অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বছরে দেশে আসছে শত কোটি টাকার আইস বা ক্রিস্টাল মেথ। মাদক নমর্িূল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা তৎপর থাকলেও পাশের দেশ থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের এই মাদক আসছেই। অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আইসসহ মাদক ঠেকাতে অভিযান আরও জোরদার করার কথা বলছেন। ফেনসিডিল-ইয়াবার চেয়েও মারাত্মক মাদক আইস। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের মতে,আইসে ইয়াবার মূল উপাদান অ্যামফিটামিনের পরিমাণ অনেক বেশি। মানবদেহে ইয়াবার চেয়েও বহুগুণ ক্ষতি করে আইস। এটি সেবনের ফলে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার জটিলতা এবং মানসিক অবসাদ ও বিষন্নতার ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। শারীরিক ও মানসিক উভয়ক্ষেত্রে রয়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। এ মাদকের প্রচলনের ফলে তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত ও অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে।

বিজিবি সূত্র জানায়, গত এক বছরে বিজিবি কক্সবাজার রিজিওনের অধীন ব্যাটালিয়নগুলোর সদস্যরা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার ও বান্দরবানে পাচারের সময় মালিকবিহীন অবস্থায় বিভিন্ন মাদকদ্রব্য জব্দ করেন। এর মধ্যে রয়েছে ৯০ লাখ ৮০ হাজার ৪৭৭টি ইয়াবা, ২৩ দশমিক ৭৫২ কেজি ক্রিস্টাল মেথ, ৬ হাজার ৭৬৭ ক্যান বিয়ার, ১ হাজার ৩৩৯ বোতল মদ, ১৫৪ বোতল ফেনসিডিল, ২০৬ লিটার বাংলা মদ, ১৭ কেজি গাঁজাসহ বিভিন্ন প্রকারের ট্যাবলেট, সিগারেট ও অ্যামোনিয়াম সালফার। এসব মাদকদ্রব্যের সিজার মূল্য ৩৯৫ কোটি ৭৬ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭৫ টাকা বলে দাবি করেছে বিজিবি। গতকাল শুক্রবার কক্সবাজারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে প্রায় ৯১ লাখ ইয়াবা ধ্বংস করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ১১টায় কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়নের উদ্যোগে এসব মাদকদ্রব্য ধ্বংস করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে ২৪ ধরনের মাদক আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং মিয়ানমার থেকে। এর মধ্যে অধিকাংশই আসে মিয়ানমার থেকে। এই জায়গাটিতে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। দেশকে বাঁচাতে, যুব সমাজকে বাঁচাতে আমাদের কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে বলেও মন্তব্য করেন আসাদুজ্জামান খান কামাল।

অনুষ্ঠানে এক বছরে উদ্ধার করা আনুমানিক ৩৯৫ কোটি ৭৬ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭৫ টাকা মূল্যের মাদকদ্রব্য ধ্বংস করা হয়েছে বলে বিজিবি জানিয়েছে। ধ্বংস করা মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ৯০ লাখ ৮০ হাজার ৪৭৭ ইয়াবা, ২৩ কেজি ৭৫২ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস, ছয় হাজার ৭৬৭ ক্যান বিয়ার, এক হাজার ৩৩৯ বোতল মদ, ১৫৪ বোতল ফেনসিডিল, ২০৬ লিটার বাংলা মদ, ১৭ কেজি গাঁজা, ৪৮ হাজার ১৯টি বিভিন্ন প্রকার ট্যাবলেট, ১০ হাজার ৯৮৪ প্যাকেট সিগারেট এবং সাত বোতল অ্যামোনিয়াম সালফার। বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজম-উস-সাকিব অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাকিল আহমেদ বক্তব্য দেন।

ঢাকায় এনে ইয়াবা বিক্রি করতেন তারা: এদিকে রাজধানীর লালবাগ থানা এলাকা থেকে ছয় হাজার পিস ইয়াবাসহ দুই মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ। ডিবি জানায়, তারা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করতেন। গ্রেফতাররা হলেন– রশিদ আহমেদ ওরফে পেটান আলী ও মো. সাইফুল ইসলাম। এ ব্যাপারে গতকাল ডিএমপির গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের লালবাগ বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মধুসূদন দাস বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি, লালবাগ থানার নীলক্ষেত সিটি করপোরেশন মার্কেট এলাকায় দুজন মাদক কারবারি ইয়াবা বিক্রির জন্য অবস্থান করছেন। এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ওই এলাকা থেকে দুই মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে ছয় হাজার পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা জানান, তারা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করতেন। তাদের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মামলা করা হয়েছে।

এছাড়া রাজধানীর পল্লবী থানা এলাকা থেকে গাঁজাসহ তিনজন মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পল্লবী থানা পুলিশ। গ্রেফতাররা হলেন- ফারুক ওরফে কালু, মো. ইকবাল চৌধুরী ও মো. কাদের। এদিন পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. পারভেজ ইসলাম বলেন, পল্লবী থানার এসআই তারিক উর রহমান শুভ বিশেষ অভিযানের সময় গোপন সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারেন কয়েকজন মাদক কারবারি পল্লবী থানায় সেকশন-১১ এলাকায় মাদক বিক্রির উদ্দেশ্যে অবস্থান করছেন। এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালায় থানার একটি টিম। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালানোর সময় ১৬ কেজি গাঁজাসহ ফারুক, ইকবাল ও কাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় মামলা করা হয়েছে। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাদক বিক্রি ও সেবনের অভিযোগে ৯৩ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর বিভিন্ন অপরাধ ও গোয়েন্দা বিভাগ। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে ১০৭৩৮ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ১৫০ গ্রাম ২০০ পুরিয়া হেরোইন, ৬৬ কেজি ৭৪০ গ্রাম গাঁজা ও ৭ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এর নিয়মিত মাদক বিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে বুধবার সকাল ছয়টা থেকে বৃহস্পতিবার ছয়টা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতারসহ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

https://dailysangram.com/post/490468