২৮ মে ২০২২, শনিবার, ১০:৩৭

সয়াবিন তেলের পেছনে ছুটছি কেন?

-ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

সয়াবিন একটি শস্যদানা। এ থেকে ভোজ্যতেল প্রস্তুত হয়। তবে এ তেলের ব্যবহার আগের দিনে ছিল না। আমাদের মা-দাদি-নানিরা সর্ষের তেল দিয়েই রানাবান্না করতেন। শুধু কী রান্না? সর্ষের তেল দিয়ে চাটনি, ভর্তা, মুড়িমাখা, আচার অনেক কিছু মুখরোচক এবং স্বাস্থ্যকর খাবার উপকরণ প্রস্তুত হয়। কিন্তু সয়াবিন দিয়ে কি এসব খাবার উপকরণ কেউ প্রস্তুত করেন? নিশ্চয়ই না। শুধু রান্না নয়, নানা পদের চাটনি, ভর্তা, আচার ছাড়াও সর্ষের তেল চুলে, শরীরে ব্যবহার করা হয়। এর স্বাস্থ্যউপকারিতা দারুণ। সর্ষের তেল শীতকালে শরীরে নিয়মিত ব্যবহার করলে ঠা-ার হাত থেকেও রেহাই মেলে। সর্দি-কাশি থেকে বাঁচা যায়। নবজাত শিশুদের সর্ষের তেল মাখাতে আমরা মা-দাদিদের দেখেছি। কেউ কেউ সর্ষের গরম তেলে আদার রস, রসুনের কুয়া, তেজপাতা, কালোজিরা ইত্যাদি দিয়ে লোশনের মতো করে শিশুদের গায়ে মাখাতেন। এতে বাচ্চার ঠা-াজনিত সমস্যা দূর হয়ে যেতো। বলুন তো সয়াবিন তেল কি কোনও মা-নানি শিশুদের গায়ে মালিশ করেন? করেন না।

কখনওসখনও বাসায় ভালো তরকারি না থাকলে সামান্য সর্ষের তেলে লবণ ও মরিচ-পেঁয়াজ ডলে বাসিভাত বা পান্তা খেয়ে নিতো মা-নানিরা। এমনকি গরম ভাতও। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এমনটা হতে দেখেছি আমরা। কিন্তু সয়াবিন তেলে কি এমন হয়?

উল্লেখ্য, আশির দশকে এ দেশে সয়াবিন তেলের ব্যবহার শুরু হয় জাতিসংঘের রিলিফ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। এরপর ধীরে ধীরে সয়াবিন তেল চালু হতে থাকে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও গ্রামে সয়াবিন তেল বিক্রি তেমন একটা হতো না।

এ দেশে সয়াবিন তেল চালু করা হয়েছে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে বা উদ্দেশ্যমূলক। বলা যায়, বিদেশনির্ভর করতে কাজটি করা হয়েছে। যেসয়াবিন ও পাম এ দেশে উৎপাদন হয় না, তা থেকে উৎপাদিত তেল কীভাবে আমাদের খাবারের আবশ্যকীয় উপাদান হতে পারে?

দেশে উৎপাদিত হয় সর্ষে। আমাদের মূল ব্যবহার্য তেল হবে সর্ষের। এ তেলই ক্রেতাদের নাগালে আনতে হবে। এ নিয়ে উদ্যোক্তাদের ভাবা দরকার।

পাশাপাশি, গরুর খামারের দিকে নজর দিতে হবে। বলা হচ্ছে, গরুপালনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। যদি তাই হয় তবে গরুর গোশতের দাম এত বাড়বে কেন? আসলে কী খামারিরা লাভ করছে নাকি অন্য কেউ? গরুপালনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে দুগ্ধজাত পণ্যের সহজলভ্যতা তৈরি হওয়ার কথা। বিশেষ করে ঘি। অল্প ঘিতেই অনেক তেলের কাজ হয়। কিন্তু আসলেই কি গরুপালনে আমরা এগিয়েছি?

ভারতের দক্ষিণাঞ্চল ও শ্রীলঙ্কায় তরকারিতে নারকেল ব্যবহার করা হয়। এটা তেলের কাজই করে।

আরও সম্ভাবনা রয়েছে রাইস ব্রান অয়েলের। ধানের ব্র্যান থেকে তৈরি এ তেলের ওপর আমরা নির্ভর করতে পারি। তিল, তিষি, সর্ষে, সূর্যমুখী, ঘি, নারকেল, বাদামের উৎপাদন বাড়ালে আমাদের ধীরে ধীরে সয়াবিনের ক্ষতিকর ও অবাস্তব প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হতে পারে।

একটা চাইনিজ প্রবাদ আছে। সেটা হলো "যা তুমি বানাতে পারো না তা খাওয়ার অভ্যাস করো না।"

সয়াবিনের মতো আরও কিছু তেলবীজ আছে যেগুলোর বিকল্প ভাবতে হবে আমাদের। অন্যথায় বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষতিকর সয়াবিনের আগ্রাসন অব্যাহত থাকবে। আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে প্রতিনিয়ত।

প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. দেবী শেঠী বলেন: সয়াবিন খাওয়ার বা রান্নার তেল নয়। সয়াবিন একটা কেমিকেল। সয়াবিন মানবদেহের জন্য একটা বিষ, যা হৃদযন্ত্রের জন্য বিশেষ ক্ষতিকর।

সয়াবিন বর্জন করুন। হার্টে ব্লক হবে না। হার্ট সুস্থ রাখতে চাইলে শরীরে যেন সয়াবিন না ঢোকে। সয়াবিন দ্বারা আর্টারিগুলো রক্তসঞ্চালনে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই সয়াবিন ছাড়–ন।

তেলছাড়া রান্না করতে শিখুন। জীবন দীর্ঘায়ু হবে। শরীর নিরোগ থাকবে। শুধু সয়াবিন নয়, যেকোনও তেলই স্লোপয়োজন।

আগেকার দিনে সাপ্তাহিক বাজার থেকে কাঁচের শিশিতে এক ছটাক বা আধ পোয়া তেল কিনে আনলে সপ্তাহ পার করতেন মা-দাদিরা।

তখন হার্টএটাক, প্রেসার, গ্যাস্ট্রিক আর ডায়াবেটিস, ব্লক, স্ট্রোকও ছিল না এতো। ৯০ থেকে ১০০ বছর কুঁজো হয়ে বেঁচেছিল মানুষ।

এখন মাসে ৫-৮ লিটারেও কুলায় না। তাই এসব রোগে মাত্র ৪০-৫০ বছর বয়সে বিনা নোটিশে মরছে মানুষ।

এবার অন্তত একটু কম তেলে রান্না শিখুন।

মানুষের আয়ু বাড়–ক, কম তেলে রান্নার প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বময়। হাঁটুন-হাসুন, জীবনটা হাতের মুঠোয়। সুস্থ দেহে সুস্থ জীবন। শতায়ু হবার চাবিকাঠি হাতের মুঠোয় নিয়ে আসুন।

কিডনি ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কাজলকান্তি দাশ প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. দেবী শেঠীকে উদ্ধৃত করে কথাগুলো বলেছেন।

সয়াবিন বীজ থেকে তেল হয় আমরা জানতাম। কিন্তু এ তেলে এখন কেমিকেল মেশানো হয়। এমন কথা আমাদের নয়। ডা. দেবী শেঠীর মতো স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীর।

প্রাণিজ চর্বি বা ফ্যাট মেশানো হয় সয়াবিনে। শূকরের চর্বি থেকেও সয়াবিনের মতো ভোজ্যতেল প্রস্তুত করা হয়। চিন থেকে হাজার হাজার টন পর্কফ্যাট বা শূকরের চর্বি আমদানি করে সাভারের একটি সয়াবিন কারখানায় ভোজ্যতেল উৎপন্ন করা হতো। কিছুদিন আগে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অভিযানে এমন জঘন্য অপরাধকর্ম উদঘাটন হয়। উল্লেখ্য, পর্কফ্যাট থেকে উৎপন্ন ভেজাল ভোজ্যতেল সয়াবিন নামে ঢুকতো মুসলিমদের রান্না ঘরে। হয়তো এখনও ঢোকে। অনেক অমুসলিম বা হিন্দু কিন্তু পর্ক বা শূকরের মাংস খান না। তবে ভেজালকারীরা সয়াবিনের নামে শূকরের চর্বিজাত ভোজ্যতেল সবার রান্নাঘরে ঢুকিয়েছে। এ ভেজালকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।

বিদেশ থেকে ক্রুড অয়েল নাম দিয়ে ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়। সেটা রিফাইন তথা প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে আসে। বাজারজাত করতে করতে সেটা সয়াবিন থাকে, না বিষে পরিণত হয় তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।

সাভারের ভোজ্যতেলের কারখানার মালিক চিন থেকে পর্ক ফ্যাট আমদানি করে সয়াবিনের লেবেল লাগিয়ে তা বাজারজাত করে। সেটা পৌঁছে ভোক্তাদের রান্না ঘরে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ভোক্তারা সবাই খৃস্টান কিংবা শূকরের মাংসখোর এমন নন। শূকরের চর্বি বা পর্ক ফ্যাট থেকে প্রস্তুত ভোজ্যতেল সয়াবিন নামে ঢুকেছে মুসলিমদের রান্নাঘরেও। কারণ এ ভেজাল ভোজ্যতেলের বোতল বা কন্টেইনারে "এটা শূকরের চর্বি বা পর্ক ফ্যাট থেকে প্রস্তুত" এমন কথা লেখা থাকে না। ফলে এ ভেজাল ভোজ্যতেল জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার রান্নাঘরে ঢুকেছে। কিন্তু এমন অপরাধকর্ম চিহ্নিত হবার পর কারখানা সিলগালা কিংবা মালিকদের জরিমানা করা ছাড়া আর কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা দেশবাসীকে জানানো হয়নি এখনও।

যাই হোক, সর্ষের তেল এ দেশের মানুষের সবার প্রিয়। এর উপকারিতাও অনেক। সর্ষে এ দেশের মাটিতে ভালো জন্মে। এর চাষপদ্ধতিও সহজ। আধুনিক কৃষিবিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কার্যকর পদক্ষেপ নিলে সর্ষের আবাদ নিশ্চয়ই ভালো হতে পারে। আর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে সর্ষের তেলে স্বয়ংসম্পন্ন হওয়া খুব কঠিন নয়। এর সঙ্গে সূর্যমুখি, তিসি, বাদাম প্রভৃতির চাষও বাড়ানো যেতে পারে। রাইস ব্র্যান থেকেও ভোজ্যতেল উৎপাদনের তৎপরতা বাড়ানো যায়। এখন দেশে ভুট্টার চাষ বেড়েছে। ভুট্টা থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন করা যায় কিনা তাও পরখ করা যেতে পারে। আর দেশে সয়াবিনের চাষও বাড়ানো যায়। শুধু সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দেয়া দরকার। তাহলে আমদানি করা সয়াবিন তেলের ওপর নির্ভর করতে হবে না। ছুটতেও হবে না।

https://dailysangram.com/post/490465