২৩ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ৫:১৬

করোনা বাড়লেও রাস্তাঘাটে ফ্রি-স্টাইলেই চলছে মানুষ

* টিকা সেন্টারগুলোতে মানুষের ভিড় * জানুয়ারিতে শনাক্তরা ওমিক্রণে আক্রান্ত বেশি

ইবরাহীম খলিল : দেশে করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ২০৯ জনে। এদিকে প্রতিদিন করোনা বাড়লেও রাস্তাঘাটে হাটবাজারে ফ্রি স্টাইলেই চলছে মানুষ। এদের মধ্যে যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানার খবর নাই তেমনি উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও নেই। ফলে এক ধরনের লাগামহীন চলাফেরা চলছে। এছাড়া করোনা উৎকণ্ঠায় টিকা সেন্টারগুলোতে ভিড় করছেন অনেকেই।

গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, একদিনে নতুন করে আরও ৯ হাজার ৬১৪ করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এতে করে দেশে করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৭৪ হাজার ২৩০ জনে। এছাড়া, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা হয় ৩৪ হাজার ৩১১ জনের। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ২৮ দশমিক ০২ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৪৮২ জন। এ নিয়ে এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ৭৯ জন। এর আগে, শুক্রবার করোনা আক্রান্ত হয়ে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ভাইরাসটিতে শনাক্ত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৪৩৪ জন।

নতুন বছরে এখন পর্যন্ত যেসব নমুনা সংগ্রহ করে জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে, তার ৯০ দশমিক ২৪ শতাংশেই মিলেছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি। বাকি ৯ দশমিক ৭৬ নমুনায় পাওয়া গেছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জার্মান সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটা (জিআইএসএইডে) ওয়েবসাইটে জমা হওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র উঠে এসেছে। দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য বিভিন্ন স্থানে জিনোম সিকোয়েন্সিং করে এই ওয়েবসাইটে ফল জমা রাখা হয়।

জিআইএসএইডের তথ্য বলছে, ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সিকোয়েন্সিংয়ে জন্য সংগ্রহ করা ৪১টি নমুনার মাঝে ৩৭টিতেই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি নমুনায় পাওয়া গেছে ওমিক্রনেরেই ‘গুপ্ত রূপ’ হিসেবে পরিচিত বিএ.২ লিনেজ। অন্যদিকে, রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রাম, যশোর ও কুষ্টিয়ার নমুনাতেও ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে।

জিআইএসএইডসহ বিশ্বের অন্যান্য ডাটাবেজ সাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে এখন পর্যন্ত ৭০টি নমুনায় ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয় গত ১৪ নভেম্বর সংগ্রহ করা একটি নমুনায়। এরপর ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করা নমুনাতেও ছিল ওমিক্রনের উপস্থিতি।

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ সময় শনিবার পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪ কোটি ৬৮ লাখ ৫৬ হাজার ৪৩২ জন এবং মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬ লাখ ৩ হাজার ১৬০ জনে। আর সুস্থ হয়েছেন ২৭ কোটি ৬৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪৩ জন। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। নতুন করে দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ হাজার ৭৭৭ জন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর এ দেশটিতে। তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশটিতে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৭ কোটি ১৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৭৯ জন। মোট মৃত্যু হয়েছে ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬৪৩ জনের।

এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায় মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ন্যূনতম প্রবণতা নেই। রাজধানীর মিরপুরের ‘নিউমার্কেট শপিংমল’-এর ভেতরে-বাইরে বড় হরফে লেখা ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’। অথচ মার্কেটের ফটকে মাস্ক না পরে ঢোকার সময় কাউকে বাধা দিতে দেখা যায়নি। অধিকাংশ ক্রেতা মাস্ক ছাড়াই মার্কেটে ঢুকছে। অনেকে আবার মার্কেটে ঢুকেই মাস্ক খুলে পকেটে রেখে দেন। মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী মিলন হোসেন জানালেন, ক্রেতাদের মাস্ক পরে প্রবেশের কথা বললেই খারাপ ব্যবহার করেন। রাজধানীর অন্যান্য স্থানেও দেখা গেছে একই চিত্র।

সরকার প্রথম ২০২০ সালে ২৪ নভেম্বর করোনার সংক্রমণরোধে সরকার ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ অর্থাৎ মাস্ক পরিধান ছাড়া কাউকে কোনো সেবা দেওয়া হবে না বলে নির্দেশনা জারি করে। এরপর ‘নো মাস্ক, নো এন্ট্রি’ বা মাস্ক ছাড়া প্রবেশ নিষেধের নির্দেশনাও দেয়া হয়। গণপরিবহন, সরকারি-বেসরকারি অফিস, বিনোদনকেন্দ্র, মার্কেটে এমন নির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই।

রাজধানীতে গণপরিবহনে মাস্ক পরার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। কয়েক মাস আগেও বাসের জানালা, দরজায় ‘নো মাস্ক, নো এন্ট্রি’ লেখা থাকলেও, তা এখন নেই। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেও যাত্রীদের মধ্যে নেই তেমন সচেতনতা। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি অনেকটাই গায়েব। যাত্রীদের অধিকাংশই মাস্ক পরছেন না, যারা পরছেন তারাও ঠিকঠাক পরছেন না। বাংলাদেশ রেলওয়েতে ৫০ ভাগ যাত্রী নিয়ে চলাচলের ঘোষণা দেওয়া হলেও আন্তঃনগর ট্রেনে যাত্রীদের এসব বিধিনিষেধ মানতে দেখা যায়নি। আগের মতোই গাদাগাদি করে যাত্রীদের যেতে দেখা যায়। অনেকেই বলছেন, জরুরি প্রয়োজনে তারা বাধ্য হয়ে যাতায়াত করছেন।

এর আগে ১১টি বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। সেখানে বলা হয়েছে, ট্রেন, বাস এবং লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নেয়া যাবে। সব প্রকার যানের চালক ও সহকারীদের আবশ্যিকভাবে কোভিড-১৯ টিকা সনদধারী হতে হবে।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, হেল্পার, ড্রাইভার দিয়ে গণপরিবহণে স্বাস্থ্যবিধি মেইনটেইন করা সম্ভব নয়। এটা কোনো সংস্থার হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। স্টপেজে যাত্রী মাস্ক পরে উঠছে কি না, যাত্রীদের হাতে স্যানিটাইজার দেয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা, খোঁজ রাখতে হবে। যাত্রী নামানোর পরে একটা পয়েন্টে বাসগুলোকে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিচ্ছন্ন করতে হবে।

নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সংক্রমণ ২৮ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে হাসপাতালে করোনা রোগীদের জায়গা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
এদিকে রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহ শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য প্রতিদিন রোগীর ভীড় বাড়ছে। জ্বর, ঠান্ডা ও কাশির উপসর্গ নিয়ে রোগীরা সকাল থেকে সিরিয়াল দিয়ে নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন। নমুনা পরীক্ষা করতে আসা রোগীদের মধ্যে মধ্যবয়সী ও প্রবীণদের সংখ্যা বেশি।

মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ২১ জানুয়ারি দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয় ১১ হাজার ৪৩৪ জন। এদিন ৮৫৭টি ল্যাবরেটরিতে ৪০ হাজার ৪২৩টি নমুনা সংগ্রহ ও ৪০ হাজার ১৩৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ছিল ২৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এক কোটি ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৭১৫টিতে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা ২৮ হাজার ১৯২ জন।

এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতিতে সরকার আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে। এসময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারেও কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। মুগদা ৫০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে গত দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করতে রোগীর ভিড় ক্রমাগত বাড়ছে। প্রতিদিন এখানে দেড়শ থেকে ২০০ রোগীর করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। হাসপাতালের কর্তব্যরত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট শারমিন আক্তার জানান, বর্তমানে করোনা পরীক্ষার জন্য প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সব বয়সী রোগীরা এলেও মধ্যবয়সী ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যাই বেশি বলে তিনি জানান।

https://dailysangram.com/post/478343