২৩ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ৫:১৪

মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা মানুষ

এইচ এম আকতার : অব্যাহত মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ দিশেহারা। দ্রব্যমূল্যের চাপে মানুষ কতটা অসহায় টিসিবির ট্রাকের দীর্ঘ লাইন দেখলেই তা বুঝা যায়। উন্নত দেশের মূল্যস্ফীতির সহনীয় হার ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও দেশে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে এ মূল্যস্ফীতি ৬-এর ওপরে ছিল। সরকার নতুন করে করোনা প্রতিরোধে বিধিনিষেধ দিয়েছে। এ বিধিনিষেধ আরও কঠোর হলে নিম্ন আয়ের মানুষেরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। করোনাকালে দেশে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে এক জরিপে জানা গেছে। গত বছরের মার্চ মাসে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। সেই হিসাবে গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। করোনার কারণে গত বছর এপ্রিল মাস থেকে দেয়া বিধিনিষেধের পর দরিদ্রের এই সংখ্যা বেড়েছে বলে জরিপে বলা হয়েছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) যৌথভাবে এই জরিপ পরিচালনা করে। এতে বলা হয়, করোনাকালে দারিদ্র্যের কারণে দেশের ২৮ শতাংশ মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে যায়। সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ১৮ শতাংশ মানুষ শহরে আবার ফিরে এসেছে। অর্থাৎ ১০ শতাংশ মানুষ এখনো শহরে ফিরতে পারেনি।

জরিপ প্রতিবেদনটি তুলে ধরে বিআইজিডি’র নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, আয়, বেকারত্ব, খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি নানা খাতে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহর অঞ্চলের মানুষের আয় কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। গ্রামাঞ্চলে এ আয় কমেছে ১২ শতাংশ। কোভিডের আগে শহরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৭ শতাংশ, এটি সর্বশেষ জরিপে বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে। গ্রামে বেকারত্ব কোভিডকালে বেড়ে গেছে ৪ শতাংশ।

জরিপে আরও দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে দারিদ্র্য পরিস্থিতিও খুব নাজুক। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী এই এলাকায় ৩৬ শতাংশ মানুষ নতুন করে বেকার হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের তুলনায় এটি অনেক বেশি। জরিপে গ্রাম-শহর-পার্বত্য এলাকার দরিদ্র মানুষের নানা বিষয়ে উদ্বেগের কথা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে আছে ঋণ ফেরত দেয়া, চাকরির অনিশ্চয়তা, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, চিকিৎসাসেবা, শিক্ষার খরচ ইত্যাদি।

পিপিআরসি’র নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দ্বিতীয় দফার করোনা বিধিনিষেধ দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে। নতুন দরিদ্র মানুষের মধ্যে শহর থেকে গ্রামে চলে যাওয়া মানুষেরাই বেশি। এসব মানুষের জন্য প্রচলিত ধারার দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি নেয়া যাবে না। কারণ, নতুন দরিদ্র হওয়া এসব মানুষ হয়তো কারও কাছে সহায়তাও চাইতে পারবে না। নতুন কাজের সন্ধান চাইবে। নীতিনির্ধারণী স্তরে এসব মানুষের বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে।
ডিসেম্বর মাসে এক কেজি প্যাকেটজাত লাল আটার দাম ছিল ৩৮ টাকা। নতুন বছরের প্রথম মাসেই তা হয়ে গেছে ৪৮ টাকা। গত কয়েক মাসে আটার মতো সব প্যাকেটজাত খাবারের দামই (বিধিনিষেধের পর থেকে) বেড়েছে।

সেই সঙ্গে সবজির দাম সারা বছরই ছিল চড়া। এখন ভরা শীতের মধ্যেও ভালো মানের লাউয়ের দাম ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটু বড় সাইজের ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। ভালো মানের শিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০ টাকায়।
বাস্তবতা হলো মূল্যস্ফীতির হার গত এক বছরে কখনোই ৫ শতাংশের নিচে নামেনি। উন্নত দেশের মূল্যস্ফীতির সহনীয় হার ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও দেশে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৫-এর ঘরে থাকলেই চাপ অনুভূত হয়। আর ডিসেম্বরে তা ৬-এর ঘর পেরিয়ে গেল। এই বাস্তবতায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে টিসিবির ট্রাক ও খাদ্য অধিদপ্তরের বিক্রয়কেন্দ্রে বেড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের ভিড়। সেখানে যে বাজারের চেয়ে একটু কম দামে পণ্য পাওয়া যায়, তাই এত মানুষের ভিড়।
গত বছরের আগস্টে বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়তে থাকে। পরিবহনভাড়া তখন থেকেই বাড়তে শুরু করে। এর সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো যুক্ত হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। এর প্রভাবে সবকিছুর ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টির কারণেও সবজির দাম দফায় দফায় বেড়েছে, আবার কখনো কখনো কিছুটা কমেছে।

মূল্যস্ফীতির চাপে নতুন এসব দারিদ্র মানুষরা এখন বিপাকে। অনেকে শহর ছেড়েছে। অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। অনেকে আবার কম বেতনে একই চাকরি করছে। সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও তাতে তেমন কাজে আসেনি। উল্টো সয়াবিন তেল,আটা,চাল পেঁয়াজসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে মানুষের আয় বাড়েনি।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের জন্য বাংলাদেশের প্রধান ঝুঁকি হচ্ছে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংকট। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করায় সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এ বিধিনিষেধ আরও কঠোর হলে নিম্ন আয়ের মানুষেরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

প্রায় দুই বছর ধরে এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নতুন বিধিনিষেধ। সীমিত পরিসরে বিধিনিষেধ শুরু হয়ে গেছে। পরিস্থিতির আরও অবনিত হলে সরকার কঠোর বিধিনিষেধের দিকেও যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সায়েমা হক বলেন, এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, যাতে সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বড় ধরনের প্রভাব না পড়ে এবং নিম্ন আয়ের, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের ক্ষতি না বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ওএমএস বা রেশনের মাধ্যমে সুলভমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজানোর মাধ্যমে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানো এবং নতুন দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বেষ্টনীর আওতায় আনার বিকল্প নেই বলে সায়েমা হক মনে করেন। সায়েমা হক আরও বলেন, কর্মসংস্থান চাঙা করার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নীতিনির্ধারণের মূল বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত।

চলমান বৈশ্বিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি ঠিক উচ্চ চাহিদার কারণে নয়, ঘটছে সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটার কারণে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্বালানির তেলের মূল্যবৃদ্ধি। কয়েক দফা বিধিনিষেধের কারণে মানুষের চাহিদা অপূর্ণ আছে। এ কারণে চাহিদাজনিত চাপ কিছুটা আছে, তবে সেটা শিগগিরই মিটে যাবে বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ আরও কিছুদিন থেকে যাবে বলেই ধারণা করা যায়।

উন্নত বিশ্বের মতো সরকার এখনো কিছু প্রণোদনা দিচ্ছে। রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এতে রপ্তানিকারকদের সুবিধা হলেও আমদানিকারকদের ব্যয় বেড়ে যাবে। চাল, ডাল, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল, শিশুখাদ্য, মসলা, গম, বিদেশ ভ্রমণ ও বিদেশে চিকিৎসার খরচ বাড়বে। সঙ্গে কিছু খাতে ভর্তুকিও আছে। অর্থাৎ সরকার এখন অর্থনীতি সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। এসব কারণে মূল্যস্ফীতি আরও কিছুদিন বাড়তি থাকবে বলেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংকট তীব্র হলে শোচনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়।

https://dailysangram.com/post/478338