২৩ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ৫:১০

করোনার মুখে খাওয়ার বড়ি বাজারে এসেছে : দেখা যাক কি সুফল দেয়

আসিফ আরসালান : পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর আর বাংলাদেশ আমলের ৫০ বছর-মোট ৭৪ বছর কেটে গেল বাংলাদেশের। মোট পৌনে একশত বছর। কম সময় তো নয়। বরং সুদীর্ঘ এক সময়। এত দীর্ঘ সময়েও এ দেশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে হাজার হাজার মাইল পেছনে পড়ে আছে। এর মধ্যে পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর না হয় বাদই দিলাম। বলা হয়, ওটা নাকি ঔপনিবেশিক আমল ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ আমল? স্বাধীন বাংলাদেশেরও তো ৫০ বছর হয়ে গেল। এই তো গত মাসেই, অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসেই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করলাম। কিন্তু এই সুদীর্ঘ ৫০ বছরেও আমরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চকিৎসা বিজ্ঞান এবং গবেষণায় এত পিছিয়ে আছি কেন? স্বাস্থ্য খাতে আমাদের শুধু দৈন্যদশা নয়, রীতিমত হাবিজাবি অবস্থা।

এসব অনেক পুরানা কথা। কিন্তু সেই পুরানা কথাই নতুন করে মনে পড়ছে পিজি বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের ভিসির একটি তথ্য দেখে। আজ সারা দেশ যখন ওমিক্রনের আতঙ্কে অস্থির প্রহর গুনছে, যখন মাত্র ২০ দিনে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১শত থেকে ১০ হাজার ৮৮৮ তে উন্নীত হয়েছে (২০ জানুয়ারি) তখন দেখা যায় যে ৯ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত হাসপাতালে যত করোনা রোগী ভর্তি হয়েছে তার সকলেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। এদের মধ্যে একজনও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত নন। এসব তথ্য প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শরফুদ্দিন আহমদ। একটি গবেষক দল কর্তৃক প্রণীত গবেষণা রিপোর্টের তথ্য পরিবেশন করছিলেন ভাইস চ্যান্সেলর। আবার একই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে চলতি মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত আলোচ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যতজন রোগীকে পরীক্ষা করেছেন তার ২০ শতাংশই ওমিক্রনে আক্রান্ত। এই তথ্যটি তারা কোথায় পেলেন তার কোনো সূত্র তারা উল্লেখ করেননি। প্রথমে ডেল্টা আক্রান্তদের সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সেটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কারণ তারা হাসপাতালের ভর্তি রোগী। কিন্তু পরবর্তী যে ২০ শতাংশের কথা বলা হয়েছে তাদেরকে গবেষকরা কোথায় পেলেন? তারা তো হাসপাতালের রোগী নন। আর গবেষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরীপ করেছেন, এমন কথা তো বলাও হয়নি, বা শোনাও যায়নি।

গবেষণা পত্রে বলা হয় যে বাংলাদেশে ওমিক্রনের প্রথম কেসটি ধরা পড়ে ৯ ডিসেম্বর। গত ১৫ জানুয়ারি ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৫। এই ৫৫ সংখ্যাটিই বা তারা কোথায় পেলেন? প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন হাজারে হাজারে-মাত্র ১ সপ্তাহে ৪ হাজার থেকে ১০,৮৮৮ তে উন্নীত হয়েছে। তাহলে এই হাজার হাজার রোগীর মধ্যে ওমিক্রন আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৫৫?

আবার ঐ গবেষকরাই বলছেন যে তাদের হাসপাতালে ভর্তি যেসব রোগীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তারা সকলেই ডেল্টায় আক্রান্ত। ৮ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি-এই এক মাসে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৯৬ টি। আবার গত বছর ২৯ জুন থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়েছে ৭৬৯ টি নমুনা। এদের মধ্যে ৯৮ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের। ১ শতাংশ বিটা ভ্যারিয়েন্টের এবং ১ শতাংশ নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট।

॥ দুই ॥
এবার করোনা ভাইরাস এত দ্রুত ছড়াচ্ছে যে পরিসংখ্যান সংরক্ষণে তাল মেলানো সম্ভব হচ্ছে না। ২০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার পত্র পত্রিকায় দেখলাম কয়েকটি পরিসংখ্যান। যেমন গত বছরের ২৬ জুন থেকে ২ জুলাই-এই এক সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছিল ৩৮৬৮ থেকে ৪০১৯ এ। অর্থাৎ এক সপ্তাহে বৃদ্ধির হার মাত্র ৪ শতাংশ। ২০২১ সালের ১৯ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই-এই ৯ দিনে শনাক্ত বেড়েছিল ১৩,৩২১ থেকে ১,৬২,৩০২ জন। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ২২ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের চলতি মাস, অর্থাৎ এই জানুয়ারির ১৩ থেকে ১৯ জানুয়ারি-অর্থাৎ এই এক সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৫৯ থেকে সাড়ে ৯ হাজার। অর্থাৎ এক সপ্তাহে সংক্রমিত হয়েছেন ৬ হাজার ১ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন ১ হাজার মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। গত বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনা দেখা দেয়ার পর এটিই সর্বোচ্চ সংক্রমণ।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ৬ হাজার রোগীর সকলেই কি ওমিক্রনে সংক্রমিত? নাকি সকলেই ডেল্টায় সংক্রমিত? জানি, এই মুহূর্তে সেটি কেউ বলতে পারবেন না। সেটি বলতে গেলে যে মেকানিজমের দরকার সেটি বাংলাদেশের নাই। এটি করতে গেলে প্রয়োজন জেনোম সিকুয়েন্সিং (Genom Sequencing)। বাংলাদেশে দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক জেনোম সিকুয়েন্সিংয়ের ক্যাপাসিটি কত? কতজন বিজ্ঞানী বা বিশেষজ্ঞ রয়েছেন? আমরা কেউ জানি না। সরকারও সেগুলো প্রকাশ করে না।

জেনোম সিকুয়েন্সিং না করে কিভাবে বলা যায় যে অমুক কেসটা ডেল্টা, অমুক কেসটা বিটা, ওমুক কেসটা ওমিক্রন ইত্যাদি? আধুনিক জগতে বিজ্ঞানের অন্যতম দুটি শ্রেষ্ঠ অবদান- ডিএনএ টেস্টিং এবং জিন সিকুয়েন্স। এই দুটি ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি কতদূর? স্বাধীন জাতি হিসাবে আমরা ৫০ বছর পার করছি। ৫০ বছর কিন্তু কম সময় নয়।

॥ তিন ॥
১লা জানুয়ারি সংক্রমণ ছিল মাত্র ৩৭০ জন। আর মাত্র ২০ তারিখে, অর্থাৎ ২০ দিনে সেই সংখ্যা সাড়ে ১০ হাজার। তাহলে এই ২০ দিনে বৃদ্ধি কত হাজার শতাংশ? আর এই সাড়ে ১০ হাজারই কি ডেল্টা? নাকি সাড়ে ১০ হাজারই ওমিক্রন? কেউ বলতে পারে না। পিজি ভার্সিটির ভিসির তত্ত্বাবধানে যে গবেষণা পারিচালিত হয়েছে সেখানে দেখা যায় যে, যাদের ওপর গবেষণা হয়েছে তাদের ৮০ শতাংশই ডেল্টা এবং ২০ শতাংশ ওমিক্রন। তবে তারা ধারণা করছেন যে হাসপাতালের বাইরে যারা হোম আইসোলেশনে আছেন তাদের ৯০ শতাংশেরও বেশির ভাগ ওমিক্রনে আক্রান্ত।

করোনা থেকে তাহলে মুক্তির উপায় কি? পৃথিবীজুড়ে বলা হলো যে ভ্যাকসিনই হলো মুক্তির উপায়। মানুষ প্রথম ডোজ নিল। কিন্তু তারপরেও করোনা হলো। বলা হলো, প্রথম ডোজ পূর্ণ রোগ প্রতিরোধ দেয় না। বলা হলো, দ্বিতীয় ডোজ দিলে পূর্ণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায়। দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হলো। কিন্তু দেখা গেল, দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পরেও করোনা হচ্ছে। তাহলে উপায় কি? বলা হলো যে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার ৬ মাস পর টিকার কার্যকারিতা আর থাকে না। অতএব বুস্টার ডোজ দিতে হবে। বুস্টার ডোজ, অর্থাৎ তৃতীয় ডোজ। শুরু হলো বুস্টার ডোজ দেয়া। এখন দেখা যাচ্ছে, বুস্টার ডোজ নেয়ার পরও করোনা হচ্ছে। এটা দেখার পর এখন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সুর বদলেছে।

১৯ জানুয়ারি একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর মোতাবেক, স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা মনে করেন, বুস্টার ডোজ দিলে করোনা থেকে শতভাগ সুফল মিলবে, এমন নয়। এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। এটাই টিকার প্রকৃতি। তবে বুস্টার ডোজ দিলে প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে রোগীর পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে না। মৃত্যুর হারও অনেক কম হচ্ছে। আরও বলা হচ্ছে যে বুস্টার ডোজ দিলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্ম নিতে তিন সপ্তাহ সময় লাগে। এই তিন সপ্তাহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা থেকে আক্রান্ত হওয়া এড়ানো যায়। পিজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত যত টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে, বুস্টার সহ তার সব কটিকে ফাঁকি দিতে পারে ওমিক্রন। এ কারণেই কোনো কোনো দেশে টিকার চতুর্থ ডোজ দেয়ার চিন্তা ভাবনা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ইসরাইলে ইতোমধ্যেই টিকার চতুর্থ ডোজ দেয়া শুরু হয়েছে।

॥ চার ॥
আমি আগেও বলেছি এবং আজও বলছি যে করোনা সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। বরং দেখা যাচ্ছে যে যতই দিন যাচ্ছে ততই নিত্যনতুন তত্ত্ব (থিওরী) শোনানো হচ্ছে।

এর চেয়ে বরং করোনার যে ওরাল ট্যাবলেট (মুখে খাওয়ার বড়ি) বাজারে এসেছে সেটা ভাল ফল দিচ্ছে বলে ব্যবহারকারীরা বলছেন। মলনুপিরাভির এসকেএফ বাজারে ছেড়েছে। নাম দেয়া হয়েছে মনুভির। ডাক্তাররা ব্যাপকভাবে এই ওষুধ প্রেসক্রাইব করছেন। ফাইজারের ওরাল ট্যাবলেট প্যাক্সলোভিড এনেছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লি:। নাম দিয়েছে ‘জুপিটাভির’। এখনও কোনো চিকিৎসক এটি প্রেসক্রাইব করেছেন বলে শুনিনি। দেখা যাক, জুপিটাভির কেমন ফল দেয়।

Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/478328