২০ জানুয়ারি ২০২২, বৃহস্পতিবার, ১২:১৩

কে বড় : মানুষ না ইঁদুর

মানুষ তো শুধু কৃষিকাজ করেই বাঁচতে পারতো। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে মানুষ এতটা মত্ত হয়ে পড়লো কেন? আসলেই কি এর এতটা প্রয়োজন ছিল? প্রশ্ন জাগে, এই প্রয়োজনটা নির্ধারণ করবে কে? আর প্রয়োজনের মানদণ্ডই বা কী? ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা বাদই দিলাম। রাষ্ট্র, দেশ ও জনগণের প্রয়োজন নির্ধারণ করে, বাজেট প্রণয়ন করে। কিন্তু রাষ্ট্রের খরচের খাতগুলো তো এক রকম হয় না। কোনো রাষ্ট্রের বাজেটে কৃষি গুরুত্ব পায়, কোনো রাষ্ট্রের বাজেটে আবার সমরাস্ত্র। তবে বহু রাষ্ট্রের বাজেটেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত কাক্সিক্ষত গুরুত্ব পাচ্ছে না। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বর্তমান সভ্যতায় সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতা যেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে, তাতে মানবিক বিষয়গুলো কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এমন অভিযাত্রা মানব জাতিকে কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে? পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা লক্ষ্য করি অনেক বৈচিত্র্য। মাটি, সাগর, আকাশ এক রকম নয়- সেখানে বৈচিত্র্য আছে। তবে এই বৈচিত্র্যে একটা ঐক্যের সুর আছে। সেটা কল্যাণের সুর। কিন্তু মানব সমাজে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে যে পার্থক্য বা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়- সেখানে মানব কল্যাণের সুর ধ্বনিত হয় না কেন? ফলে প্রশ্ন জাগে- কেন এই সমাজ, কেন এই রাষ্ট্র?

সমাজ গঠন, রাষ্ট্র গঠন মানুষের জন্য খুবই ইতিবাচক বিষয় ছিল। মানুষ তো উন্নত জীবন চেয়েছিল। কিন্তু সেই আকাক্সক্ষার বাস্তব রূপটা এখন কেমন? মানুষ নিজ দেশে শান্তিতে বসবাস করবে, অন্য দেশের সাথে গড়ে তুলবে মৈত্রীর বন্ধন- এমন আকাক্সক্ষাই তো মানবিক আকাক্সক্ষা। বর্তমান সভ্যতায় মানুষ বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে অনেক অগ্রসর হয়েছে, অনেক দেশ অর্থ-সম্পদে হয়েছে বেশ সমৃদ্ধ, তবে শান্তি ও মৈত্রীর বার্তা তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং হুমকি-ধমকি ও ঘৃণার বার্তাই প্রবল হয়ে উঠছে। এক দেশ অন্য দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় লাখো সৈন্যের সমাবেশ ঘটাচ্ছে। কোনো দেশ এক মাসেই তিনবার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে।

এছাড়া নিজ দেশে শক্তিশালী পক্ষ দুর্বল পক্ষের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি ছাড়াও চালাচ্ছে ঘৃণার প্রোপাগান্ডা। এত উন্নতি ও প্রগতির পর (?) বিশ্বের নেতারা এ কোন পৃথিবী উপহার দিতে চলেছেন মানব জাতিকে?

এমন বাতাবরণে ‘ঘৃণা ভাষণ’ মামলায় উত্তরাখন্ড সরকারকে নোটিশ পাঠিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এনভি রমনা, বিচারপতি সূর্যকান্ত ও বিচারপতি হিমা কোহলির এজলাস থেকে গত ১২ জানুয়ারি এক নোটিশ দেয়া হয়। পাশাপাশি ২২ জানুয়ারি এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। জনস্বার্থে করা এই মামলার আরজিতে বলা হয়, উত্তরাখন্ডের হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত ধর্মসংসদ সম্মেলন থেকে যারা দেশে মুসলিমদের হত্যার ডাক দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক। সাংবাদিক কুরবান আলী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অঞ্জনা প্রকাশ গত সোমবার এই জনস্বার্থ মামলা করেন। সুপ্রিম কোর্টে সেদিনই তা গৃহীত হয়। বুধবার ছিল এই মামলার প্রথম শুনানি।

আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী কংগ্রেস নেতা কপিল সিবাল প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, ‘ওই ধর্ম সংসদ থেকে কী ধরনের ভাষণ দেয়া হয়েছিল, অনুগ্রহ করে তাতে একবার চোখ বুলান। আমি তা নিজে থেকে পড়তে চাই না। তাতে নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতে পারে।’ প্রধান বিচারপতি তখন জানান, তারা রাজ্য সরকারকে নোটিশ দিয়েছেন। সিবাল তখন কেন্দ্রীয় সরকারকেও নোটিশ পাঠানোর আরজি জানান।

ঘৃণা প্রচার, ঘৃণা ভাষণ কোনো দেশেই সুস্থ নাগরিকদের কাজ হতে পারে না। কারণ এমন কর্মকাণ্ড নিজ দেশ ও জনগণের জন্য ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া ঘৃণা প্রচার বিশ্ব পরিবেশেও মন্দ প্রভাব ফেলতে পারে। বিষয়টি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে গেছে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ তাকিয়ে আছে আদালতের দিকে। মানব সমাজে ব্যর্থতার চিত্র আছে, তবে হতাশা মানুষের সাথে যায় না। ইঁদুরের ঘটনা থেকেও মানুষ অনুপ্রাণিত হতে পারে।

স্থলমাইন খুঁজে বের করে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল সে। কোনো মানুষের কথা বলছি না, বলছি একটি ইঁদুরের কথা। ওর কর্মজীবনে এসেছে একের পর এক সফলতা। বীরত্বের জন্য জুটেছে স্বর্ণ পদকের মত সম্মাননাও। গত বছরের জুনে মাইন খোঁজার কাজ থেকে অবসরে যায় প্রাণীটি। মানুষের প্রাণ বাঁচানো কম্বোডিয়ার সেই ইঁদুরটি মারা গেছে। ওর নাম মাগাওয়া। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, মাগাওয়া তার পাঁচ বছরের কর্মজীবনে ১০০টির বেশি স্থলমাইন ও অন্য বিস্ফোরক খুঁজে বের করতে সমর্থ হয়। মাগাওয়ার জন্ম আফ্রিকায় হলেও ওর কর্মস্থল ছিল কম্বোডিয়া।

বেলজিয়ামের দাতব্য প্রতিষ্ঠান অ্যাপোপো মাইন খুঁজে বের করতে ইঁদুরকে প্রশিক্ষণ দেয়। কম্বোডিয়া জুড়ে আনুমানিক ৬০ লাখ মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সেসব মাইন শনাক্ত করতে মাগাওয়াকে তানজানিয়া থেকে নিয়ে আসা হয় কম্বোডিয়ায়। বেলজিয়ামে নিবন্ধিত তানজানিয়াভিত্তিক দাতব্য সংস্থা অ্যাপোপোতে অনেক ইঁদুরকে মাইন শনাক্তের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ১৯৯০ সাল থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া এসব ইঁদুরকে বলা হয় ‘হিরো র‌্যাটস’। মাগাওয়া ছিল সেসব হিরো র‌্যাটস-এর একটি। অ্যাপোপো জানায়, গত সপ্তাহেও মাগাওয়ার শরীর ভাল ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সে নড়াচড়া কমিয়ে দেয়, বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকতো সে। শেষ কয়েকদিন খাবারের প্রতিও তার তেমন আগ্রহ ছিল না।

অ্যাপোপো কর্তৃপক্ষ বলেছে, টেনিস খেলার একটি মাঠের সামনে কোনো জায়গায় মাইন আছে কিনা, তা মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই বের করতে পারতো মাগাওয়া। এই কাজটি মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে কোনো মানুষকে করতে সময় লাগে এক থেকে চার দিন। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের কারণে ২০২০ সালে চৌকস মাগাওয়া পায় পিডি এস এ স্বর্ণপদক। উল্লেখ্য যে, প্রাণীদের সাহসী কর্মকাণ্ডের জন্য এই স্বর্ণপদক দেয়া হয়ে থাকে। বৃটিশ সরকার এই পদক প্রদান করে। অ্যাপোপোর ৭৭ বছরের ইতিহাসে মাগাওয়াই প্রথম পিডিএসএ পদক অর্জন করে। ছোট্ট প্রাণী মাগাওয়ার স্মৃতিচারণ করছেন এখন অনেকেই। অ্যাপোপোর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মাগাওয়াকে হারানোর বেদনা অনুভব করছি আমরা। সে অসাধারণ কাজ করেছে, তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ’। এই ইঁদুরটির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার যৌক্তিক কারণ আছে বটে। কম্বোডিয়ায় একটি মাইনও পুঁতে রাখেনি কোনো ইঁদুর। বরং মানুষই কম্বোডিয়া জুড়ে ৬০ লাখ মাইন পুঁতে রেখেছে। ধ্বংসাত্মক ওই পরিবেশ থেকে ১০০টিরও বেশি স্থলমাইন ও অন্য বিস্ফোরক খুঁজে বের করে দিয়েছে ছোট্ট ইঁদুর মাগাওয়া। এখন প্রশ্ন জেগেছে কে বড়- মানুষ না ইঁদুর? এমন প্রশ্নের কোনো জবাব আছে কি বর্তমান মারণাস্ত্র-সভ্যতার মহান নেতাদের কাছে?

https://dailysangram.com/post/478017