৩ জানুয়ারি ২০২২, সোমবার, ৫:০১

৫.৩ থেকে ৫.৭ শতাংশ নির্ধারণ

নিয়ন্ত্রণে নেই মূল্যস্ফীতি

বাড়ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের দুর্ভোগ * নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে ধ্বংস হবে শিল্প খাত-আহসান এইচ মনসুর

রাজধানীর হাজারীবাগ ঝাউচরে চায়ের দোকানি আব্দুল আজিজ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন চাল ও মুদি দোকানে। চারজনের সংসারে সামান্য আয় দিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি আঘাত হেনেছে তার আয়ের ওপর। ব্যয়ের সঙ্গে তাল দিতে না পারায় চালের দোকানে ৭ হাজার ও মুদি দোকানে সাড়ে তিন হাজার টাকা পাওনা দাঁড়িয়েছে।

একই এলাকার দিনমজুর শাহজাহান মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় দিয়ে সাত সদস্যের সংসার চালাতে পারছেন না। তিন হাজার টাকা ঘর ভাড়া, বাচ্চার মাদ্রাসায় পড়ার খরচ আরও ৩ হাজার টাকা। এ ব্যয় নির্ধারিত। অবশিষ্ট ৯ হাজার টাকায় সাতজনের পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এজন্য তিনি ২ সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব দিয়েছেন শ্বশুরালয়ে। তার মতে, আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে বাজারে। ফলে সবার জন্য ডাল-ভাত জোগাড় করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি এসব নিম্নআয়ের মানুষকে বেগতিক অবস্থায় ফেলছে। এমনিতেই করোনার কশাঘাতে চাকরিহারা, বেকার, আয়-রোজগার কমে যাওয়া মানুষ খরচের টাকা জোগাড় করতে পারছে না। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপ বড় ধরনের ভোগান্তিতে ফেলেছে অনেক পরিবারকে।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে দেশে। ফলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে ধরে রাখতে পারছে না সরকার। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে মূল্যস্ফীতির হার বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থবছরের শুরুতে এ হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত ওই ঘোষণার মধ্যে রাখা যাচ্ছে না। সংশোধিত মূল্যস্ফীতির হার দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে এর নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

যদিও শনিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি সারাবিশ্বেই আছে। গত ১৫ বছরে মূল্যস্ফীতির হার দেশে গড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ হার আরও বেশি ছিল। কাজেই আমি বলব, বাংলাদেশ একটি অসাধারণ দেশ। আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি নেই।’

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বিশ্বব্যাপী পণ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। যে কারণে দেশে জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে পণ্য ও সেবা খাতে। এ বছর মূল্যস্ফীতি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। যে কোনো মূল্যে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এটি সম্ভব না হলে মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি ও রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এজন্য নজর দিতে হবে মূল্যস্ফীতির দিকে।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি বেড়েছে। এটি স্থিতিশীল না করা গেলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। এখন মূল্যস্ফীতি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকায় ৪৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যান্য দেশে দুই থেকে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিরাজ করছে মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশে এটি সহনীয় পর্যায়ে আছে তা দেখানোর চেষ্টা চলছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের যে তথ্য তার সঙ্গে বাস্তবতার তফাত আছে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে ধনীকে আরও ধনী করবে। এছাড়া সরকারের কিছু নীতি পরিবর্তন করতে হবে। ব্যাংকের সঞ্চয় সুদহার ৬ থেকে ৭ শতাংশ করতে হবে। তখন শিল্প ঋণের সুদ হার ডাবল ডিজিটে চলে যাবে। যা শিল্প খাতকে ধ্বংস করে দেবে।

করোনা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসার পর বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী সবকিছুর চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চড়ছে মূল্যস্ফীতির পারদ। লাগাম টানতে পারছে না সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রও। ১৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে কানাডায়। জার্মানির মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ২৯ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত মাসে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে। এ হার ১৯৯২ সালের জুনের পর সর্বোচ্চ। অক্টোবরেও দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, নভেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যা পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে আগের বছর একই মাসে ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭০। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি গেল নভেম্বরে ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ হয়েছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে তা ২০২০ সালের নভেম্বরের তুলনায় কম। ওই বছর নভেম্বরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

নভেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়েছে। এ খাতে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা আগের বছর একই সময়ে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ ছিল।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। এটি সমন্বয় করতে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো হয়। এর ফলে পণ্য ও সেবা খাতের ব্যয় বেড়ে গেছে। যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। গত এক বছরে নিত্যপণ্যের বাজারে সরকারি হিসাবে দাম বেড়েছে চাল ৭৯ শতাংশ। খোলা আটা ২৪ দশমিক ১৪ শতাংশ, খোলা ময়দা ৩৭ দশমিক ৬৮, সয়াবিন ২৮ দশমিক ১১, পাম অয়েল ৩৮ ও মসুর ডাল ৩৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/504487