১৪ নভেম্বর ২০২১, রবিবার, ১২:১০

জনশক্তি রফতানি বাড়লেও কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ

করোনা মহামারির মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের চাকরি হারানোর খবর আসতে থাকে। চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত আসে কয়েক লাখ প্রবাসী। এরপরও রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি দেখেছে দেশবাসী। সরকারের পক্ষ থেকে রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতির ধারা অব্যাহত থাকার ঘোষণা দিলেও বিশেষজ্ঞরা দ্বিমত পোষণ করেন। তারা বলেন, রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বমুখী বেশি দিন থাকবে না। অবশেষে বিশেষজ্ঞদের ধারণাই ঠিক হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ধারাবাহিকভাবে কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এদিকে ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে বছরে অভিবাসনের হার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৭১ শতাংশ কমেছে। তবে সরকারি হিসাব বলছে, গত কয়েকমাস যাবত জনশক্তি রফতানির পরিমান বেড়েছে। কিন্তু রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্নগতি অব্যহত রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন সরকারের জন্য রেমিট্যান্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাওয়ার হার উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা এর পেছনে কারণ হিসেবে মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর অর্থ লেনদেনের অবৈধ চ্যানেলগুলো চালু হওয়া, নতুন বৈদেশিক নিয়োগ কমে যাওয়া এবং প্রবাসীদের চাকরি হারানোর মতো বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছেন।

এদিকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ চলতি বছরের অক্টোবর মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ কমে এসেছে ১ হাজার ৬৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১০২ মিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে কম এসেছে ৪৫৫ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবরে রেমিট্যান্স ৪ শতাংশ কম এসেছে। সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৭২৭ মিলিয়ন ডলার। গত কয়েকমাস ধরেই প্রবাসী আয় কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৭ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রায় ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার এসেছে। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া, এই তিন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে। এ বছর এই তিন দেশ থেকে উল্লিখিত তিন মাসে গত বছরের চেয়ে ৯৩২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার কম এসেছে। বাংলাদেশ ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের চেয়ে ৭৭১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার কম রেমিট্যান্স পেয়েছে।

২০২০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি প্রবাসীরা মালয়েশিয়া থেকে ৬০৭ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন। এই পরিমাণ কমে এ বছর ২৯০ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন হয়েছে, অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছরের রেমিট্যান্স ৩১৬ দশমিক ৩৯ ডলার কম। সৌদি আরব থেকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে। এ বছর, একই সময় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৭৫২ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এ বছরের পরিমাণ ৪৪৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন। যুক্তরাজ্য ও কুয়েত থেকে আগের বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স যথাক্রমে ৬৪ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ও ২৪ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার কমে গেছে।

অথচ মহামারিতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধস নামলেও দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছিল। প্রবাসীরা দেশে ২৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে, যা অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এদিকে প্রবাসী আয় প্রবাহ যখন ধারাবাহিক পতনের মুখে তখনই সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেড়েছে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রফতানি। যা আগামীতে রেমিট্যান্সে সুদিন ফেরার ইঙ্গিত। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুসারে, অক্টোবরে বিদেশে চাকরিপ্রাপ্তদের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে, যা আগের মাসের চেয়ে ৫৫ শতাংশ বেশি। গেল বছরের আগস্টে কোভিডজনিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়ে প্রবাসী কর্মসংস্থান বাজার ফের সচল হওয়ার পর, যা এক মাসে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক অভিবাসনের ঘটনা। এ বছরের অক্টোবরে বছরওয়ারি হিসাবেও শ্রমিক অভিবাসন ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। মহামারিপূর্ব সময়ে, প্রতিমাসে গড়ে ৬০ হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে চাকরি পেতেন, যার অধিকাংশ নিয়োগ হতো মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতি গত বছর সংখ্যাটি ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনে এবং ওই বছরের এপ্রিল-জুন মাসে কোনও অভিবাসন হয়নি। মধ্যপ্রাচ্য দেশের বৃহত্তম শ্রম রপ্তানি বাজার। জীবাশ্ম জ্বালানি তেলের ক্রমশ চড়াদরের কারণে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) ভুক্ত ছয়টি তেল রপ্তানিকারক দেশের অর্থনীতিতে জোরালো বিকাশের আশাও করা হচ্ছে। একারণেই এখন প্রবাসী কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রবণতা দেখছে বাংলাদেশ। অধিকাংশ কর্মসংস্থান হচ্ছে, জিসিসিভুক্ত সৌদি আরব, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডান এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরে।

তথ্য বলছে, জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবে অক্টোবরে চাকরি পেয়েছেন ৫১ হাজার ৪৭২ জন বাংলাদেশি, যা জুন মাসে হওয়া ৪৪ হাজার ৯৮৫ জনের চাকরির চেয়ে অনেকটা বেড়েছে। তবে জুলাইয়ে সংখ্যাটি ছিল বেশ কম, এসময় মাত্র ১১,২৮২ বাংলাদেশি সৌদিতে নিয়োগ পান। আগস্টে তা কিছুটা বেড়ে ১৪ হাজার ৯১৯ জনের নিয়োগ হয় এবং সেপ্টেম্বরে নিয়োগ পান ৩১ হাজার ২৩৮ জন।

রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা বলছেন, সৌদি যেতে মাথাপিছু এক লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা লাগলেও এ দেশের বিদেশ গমনেচ্ছুকদের থেকে তারা (সৌদি নিয়োগদাতারা) ভালো সাড়া পাচ্ছেন না। অদক্ষ শ্রমিকেরা মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে তুলনামূলক ভালো পরিবেশ ও বেতনের সুযোগ থাকায় বরং মালয়েশিয়া যেতেই বেশি আগ্রহী। তবে ২০১৮ সাল থেকেই বন্ধ রয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার, যা আগামী বছর সচল হওয়ার আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান জানান, কিছু দেশের কর্মীদের জন্য ভিজিট ভিসায় তিন মাসের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তারপরে তারা সেগুলোকে ওয়ার্ক ভিসায় রূপান্তরিত করতে পারেন এবং চাকরির চুক্তি অনুসারে একটি নির্দিষ্ট সময় সেখানে থাকতে পারেন। এছাড়াও রোমানিয়া, পোল্যান্ড ও সাইপ্রাসের মতো কিছু ইউরোপীয় দেশেও কিছু চাকরির চাহিদা রয়েছে।

করোনা মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে নজিরবিহীন রেমিট্যান্স প্রবাহ আসে। গত বছরের জুলাইয়ে ২৬০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসে দেশে। যা একক মাসের জন্য রেকর্ড। কিন্তু সেই রেমিট্যান্স প্রবাহ এখন হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ১ নভেম্বর প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়কালে বাংলাদেশি প্রবাসীরা মোট ৭ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) গত ডিসেম্বরে প্রাক্কলন করেছিল যে, ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে বছরে অভিবাসনের হার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৭১ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালে সাত লাখের বেশি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বিদেশে যায়। কিন্তু বিএমইটি থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, গত বছর বিদেশে পাড়ি জমান মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার কর্মী। মহামারির মধ্যে প্রায় ৫ লাখ অভিবাসী দেশে ফিরে এসেছেন এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের হার গত বছর উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা এখন যে রেমিট্যান্স পাচ্ছি, তা আসছে ‘স্টক মাইগ্রেন্টস’ থেকে। যে শ্রমিকরা এখন অভিবাসন করছেন, তারা আগামী বছরগুলোতে ধীরে ধীরে রেমিট্যান্স প্রবাহে অবদান রাখবেন। গত কয়েক মাসের মতো নিকট-ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ রেমিট্যান্সে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখতে পারে। তবে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি একটা অঙ্কে এসে থেমে যেতে পারে। অধ্যাপক মোস্তাফিজুর জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষণ প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করতে হবে যাতে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠানো নিরুৎসাহিত হয়। এছাড়াও, সরকারের উচিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল রাখা।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান জানান, মহামারির মধ্যে রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি অনেককেই বিস্মিত করেছিল। এক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা হলো, সব ধরনের অর্থ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসছিল। যাতায়াতের বিধিনিষেধ ও বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি কার্যত বন্ধ থাকার কারণে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিল না। কিন্তু এই অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর আবারো চালু হয়েছে। ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। গত এক বছরে অনেক কর্মী বিদেশে যেতে পারেনি এবং এটি রেমিট্যান্সের ওপর একটি ‘সমষ্টিগত প্রভাব’ ফেলেছে। অধ্যাপক সেলিম বলেন, আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্স কমে যাওয়াতে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এবং বিনিময় মূল্যের ওপর চাপ পড়বে। যেহেতু সরকারের জন্য রেমিট্যান্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত মাসে বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। কারণ মহামারির সময় যেসব বাংলাদেশি নাগরিক দেশে ফিরে এসেছিলেন, তারা এখন ফিরতে শুরু করেছেন।

https://dailysangram.info/post/471148