১৪ নভেম্বর ২০২১, রবিবার, ১২:০৭

আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা : করোনা সম্পর্কে কিছু প্রচলিত ধারণা সঠিক নয়

পৌনে দুই মাস হলো, ‘দৈনিক সংগ্রামের’ সম্মানিত পাঠক ভাই বোনদের সামনে আসতে পারিনি। কারণ, আমার করোনা হয়েছিল। সাধারণত বলা হয় যে কেউ করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হলে তিনি ১৪ দিন অসুস্থ থাকেন। তারপর তার করোনা নেগেটিভ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ এবং স্বাভাবিক হয়ে তার দৈনন্দিন কাজ কর্মে ফিরে যান। প্রচলিত ধারণায় আরো বলা হয় যে, ১৪ দিন পরে নেগেটিভ হলেও সংক্রমিত হওয়ার ১২ দিন পরেই ভাইরাসগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ১৪ দিন পরে ঐ ভাইরাসগুলো মরে যায়। ১৪ দিন পরে টেস্ট করলেও যদি পজিটিভ আসে তাহলে ঐ ডেড সেলগুলোই পজিটিভ হিসেবে আসে। এগুলোকে False positive বলে। একটু আগেই বলেছি যে এগুলোই সব প্রচলিত ধারণা এবং এসব কথাই আমরা খবরের কাগজে এবং ইন্টারনেটে পড়েছি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এসব কথা সত্য হয়নি। সে সব কথা একটু পর বলছি। তার আগে বলতে চাই যে দেশে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেল। পবিত্র কুরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে দেশে কয়েকটি মন্দির এবং হিন্দুদের দেব দেবীর কিছু মূর্তির ওপর কায়েমী স্বার্থবাদীরা হামলা করেছে। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে প্রচন্ড সহিংসতা হয়েছে। এই সহিংসতায় কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তেও পারে। ঠুনকো বাহানায় জ্বালানি এবং ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। সেই অজুহাতে ট্রাক ও বাস ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। অথচ দেশের ৯৫ শতাংশ বাস ডিজেলে নয়, গ্যাসে চলে। তারাও ভাড়া বাড়িয়েছে। দেশের সমস্ত সিএনজি (প্রাক্তন বেবী ট্যাক্সি) গ্যাসে চলে। তারাও বেশি ভাড়া নিচ্ছে। এসব নিয়ে লেখা যেত এবং লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এসবের কোনো বিষয়েই লেখা হলো না। যাই হোক, একটু আগেই আমি বলেছি যে করোনা সম্পর্কে যেসব ধারণা প্রচলিত রয়েছে তার সব কিছু যে সর্বাংশে সত্য নয় সেটি আমি ব্যক্তিগতভাবে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি। সেই বিষয়টিই এখন আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

॥ দুই ॥
আমার পজিটিভ ধরা পড়ে ২২ সেপ্টেম্বর। গত ৮ অক্টোবর ১৮ দিন পর আমি যখন টেস্ট করি তখনও আমার পজিটিভ আসে। অথচ আমার নেগেটিভ আসার কথা। কেউ যদি মনে করেন যে ১৮ দিন পর যে পজিটিভ আসে সেগুলো ছিল ডেড সেল বা মৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃত ভাইরাস। কিন্তু বাস্তবে সেটি ছিল না। আমি আমার ব্যক্তিগত ঘটনা উল্লেখ করছি একারণেই যে, আমি ৮ অক্টোবর গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হই। ১০ দিন হাসপাতালে ছিলাম। এই কয়দিন হাসপাতালে ডাক্তার নার্স এবং অন্যান্য করোনা রোগীর সাথে অনেক আলোচনা হয় এবং করোনা সম্পর্কে এমন অনেক কথা জানতে পারি যেগুলো করোনা সম্পর্কে নতুন এবং আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্জাত। সেসব নতুন কথাই আপনাদেরকে জানাবো।

৮ তারিখ বিকাল ৪ টার দিকে আমার যুগপৎ প্রচন্ড বমি, পাতলা পায়খানা অর্থাৎ ডায়রিয়া এবং গলগল করে কফ পড়তে থাকে। অবস্থা ক্রিটিক্যাল হয়ে পড়লে আমাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে আমাকে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির প্রফেসর মাহবুবুল আলমের অধীনে ভর্তি করা হয়। ইমার্জেন্সীতে তিনটি ইনজেকশন দিয়ে আমার বমি এবং লুজ মোশন বন্ধ করা হয়। তারপর সপ্তম তলায় অবস্থিত কোভিড ইউনিটে স্থানান্তরিত করা হয়। আমাকে রাখা হয় ৭২১ নং কেবিনে। পরদিন আমাকে মেডিসিনের প্রফেসর তৈমুর নওয়াজের অধীনে নেয়া হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে বিগত ৪৫ বছর ধরে আমি আইবিএসের রোগী। আমি ভেবেছিলাম যে আমার আইবিএস প্রকট আকার ধারণ করেছে। কিন্তু পরদিন থেকে সম্পূর্ণভাবে কোভিডের চিকিৎসা করা হয়। আমার ইকো, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ নানান পরীক্ষা করা হয়। সব রিপোর্টই ভাল ছিল। জানতে পারি যে করোনা ভাইরাস আমার আইবিএসে আঘাত হেনেছে। এজন্য প্রফেসর নওয়াজ আমার অন্যান্য সব ওষুধ বাতিল করে শুধুমাত্র করোনার ট্রিটমেন্ট করেন।

হসপিটালে থাকাকালীন জানতে পারি যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে তখন যখন তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল নেমে যায়। একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ বলেন যে অক্সিজেন লেভেল ৯৩ পর্যন্ত নরমাল। ৯৩ এর নীচে গেলেই চিন্তার বিষয়। আমাকে দ্বিতীয় দিন থেকেই বিরতিহীনভাবে অক্সিজেন দেয়া হয়। তারপরেও তৃতীয় বা চতুর্থ দিনের রাতে আমার অক্সিজেন লেভেল নেমে ৮৮ তে আসে। ডাক্তাররা তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাত ৪ টার দিকে আমার অক্সিজেন লেভেল ৯৪ এ উন্নীত হয়। আমার আগেও বিশ্বাস ছিল, তখনও বিশ্বাস ছিল এবং এখনও বিশ্বাস করি যে রাখে আল্লাহ মারে কে! আসলে হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। এই যে ডাক্তার সাহেবরা চিকিৎসা করে রোগীকে সুস্থ করেন সেটি আসলে ডাক্তার সাহেবরা করেননা। আসলে আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ সুস্থ হয়। ডাক্তার সাহেবরা উসিলা মাত্র। যাই হোক, ১৫ অক্টোবর আবার টেস্ট করা হয়। এবার নেগেটিভ আসে। অর্থাৎ ২৫ দিন পর আমার করোনা নেগেটিভ হয়। এখান থেকেই কতগুলো বিশেষ কথা।

॥ তিন ॥
করোনা প্রতিরোধী টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে গত বছরের শেষ প্রান্তিকে। সেটা ছিল, টিকা নিলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। আর হলেও মৃত্যু ঝুঁকি কম থাকবে এবং হাসপাতালে হয়তো না গেলেও চলবে। তবে আমার ক্ষেত্রে দেখলেন যে ৫ মাস আগে ডাবল ডোজ টিকা নিয়েও আমাকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। মিডিয়ার সাংবাদিক ভাইয়েরা যদি বিভিন্ন হাসপাতালে যেতেন তাহলে দেখতেন যে ডাবল ডোজ টিকা নিয়েও কত শত ব্যক্তিকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। ইউনাইটেড হাসপাতালে সেই চিত্র আমি দেখেছি। দেখেছি, থিওরী এবং বাস্তবের মধ্যে কত তফাৎ।

একটি সুসংবাদ এই যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর কোন ওষুধ খেতে হবে সেটিও আবিষ্কৃত হয়েছে। আবিষ্কৃত হয়েছে দুটি ট্যাবলেট বা বড়ি। একটি হলো ‘মলনুপিরাভির’, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডের দুটি কোম্পানী এই ট্যাবলেটটি আবিষ্কার করেছে। ইংল্যান্ডের যথাযথ কর্তৃপক্ষ এই ওষুধ ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষও জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের তিনটি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানীতে এই ওষুধটি আমদানি এবং বাজারজাতকরণের অনুমতি দিয়েছে। সেই মোতাবেক তারা এর মধ্যেই কিছু ট্যাবলেট বা বড়ি আমদানি করেছেন। দেখা যাক, এগুলোর কার্যকারিতা কতখানি।

দ্বিতীয় ট্যাবলেট বা বড়ির নাম ‘প্যাক্সলোভিড’। বিশ্ব বিখ্যাত মার্কিন ওষুধ প্রতিষ্ঠান ফাইজার এটি আবিষ্কার করেছে। আক্রান্ত ব্যক্তি এই ওষুধ সেবন করলে তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৮৯ ভাগ বলে দাবি করেছে ফাইজার। অনুমোদনের জন্য মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের কাছে ফাইজার আবেদন করেছে। ফাইজারের এই বড়িটি এখনও বাজারে আসেনি। আসুক, তারপর দেখা যাক, এই ওষুধের কার্যকারিতা কতখানি।

॥ চার ॥
এবার করোনা সম্পর্কে আরেকটি কথা। আমেরিকা, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বলা হচ্ছে যে টিকা নেয়ার ৬ মাস পর টিকার কার্যকারিতা হ্রাস পেতে থাকে। এজন্য ৬ মাস পর আবার টিকা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সুপারিশ করেছেন। এটিকে বলা হয় বুস্টার ডোজ। আমেরিকা ইংল্যান্ড প্রভৃতি উন্নত দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষ বুস্টার ডোজের সুপারিশ করেছেন। ঐসব দেশের অনেক মানুষ বুস্টার ডোজ নিয়েছেন। আমাদের দেশেও বুস্টার ডোজ নেয়ার বিষয়টি সরকার চিন্তা করতে পারেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছেন যে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ১৩ কোটি মানুষকে আগে টিকার আওতায় আনতে হবে। কথাটি সঠিক। কিন্তু যারা সিনিয়র সিটিজেন, অর্থাৎ যারা ৬০ বছর বা তার ঊর্ধ্বে তাদের মধ্যে যাদের দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেয়ার পর ৬ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজ দেয়ার চিন্তা করতে হবে। ১৩ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে ২০২২ সাল পার হয়ে যাবে। ততদিন কি এইসব বয়স্ক মানুষ আবার আক্রান্ত হবেন? প্রয়োজন হলে বুস্টার ডোজ প্রাইভেট সেক্টর বা বেসরকারি খাতে দেয়া যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন হলে টিকা দেয়ার জন্য ফি অর্থাৎ মূল্য ধার্য করা যেতে পারে। আমি যেটি বলছি, সেটি বাস্তব এবং বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

আমি এখনও একশত ভাগ সুস্থ হইনি। এখনও শরীর দুর্বল। আল্লাহর ইচ্ছায় আগামী সপ্তাহে আরো সুস্থ হবো বলে আশাকরি। তখন আবার রাজনীতি নিয়ে লিখবো, ইনশাআল্লাহ।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.info/post/471135