১৪ নভেম্বর ২০২১, রবিবার, ১২:০৪

চাপের মুখে রিজার্ভ

জ্বালানি তেলের চড়া দামে বাড়ছে আমদানি ব্যয়

আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজিসহ জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি নির্ভরতায় জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয়ও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৬০ শতাংশ। আর এলসি খোলার হার বেড়েছে প্রায় ৭১ শতাংশ। অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধিতে তিন মাসে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি রেকর্ড অর্থাৎ প্রায় ৪৮ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু বিপরীতে প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। অর্থবছরের চার মাসে কমেছে ২৫ শতাংশ। চাহিদার বিপরীতে আন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়ায় চাপে পড়ে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ইতোমধ্যে রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়নের নিচে নেমে গেছে। যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, এর বিপরীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়লে রিজার্ভ আরো কমে যাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে : বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত জুলাইয়ের পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় প্রতিদিনই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। করোনার কারণে বিশ্বে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ায় গত বছরের এপ্রিলে ব্যারেলপ্রতি দাম ২০ ডলারে নেমে আসে। তখন ক্রেতা আকৃষ্ট করতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে ঋণ দেয়া হতো। চলতি অর্থবছরের পর থেকে করোনা কমায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে জ্বালানি তেলের দাম। এখন বেড়ে ৯৩ ডলারে উঠে গেছে। এর প্রভাবে সার্বিক আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৮৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ১৪০ কোটি ১৮ লাখ ডলার। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। এ ব্যয় আরো বাড়ছে। এর ধারণা পাওয়া যায় তেল আমদানিতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি খোলা) হার দেখে। এ ক্ষেত্রে গত অর্থবছরে যেখানে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৭১ শতাংশ। যেমন গত অর্থবছরের তিন মাসে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল ৮৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের, সেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয়েছে প্রায় ১৪২ কোটি ডলারের। এ থেকেই আভাস পাওয়া যায়, সামনে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার চাপ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনার মধ্যে আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর আয় কমে গিয়েছিল। এখন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তারা বাড়তি উৎপাদন না করার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। সামনে ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেল ১০০ ডলারের ওপরে উঠে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এলএনজির দামও বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে : এ দিকে এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে তরলিকৃত প্রাকৃৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম ৫ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২ ডলার। এক বছরে দাম বেড়ে যাওয়ার হার ৫০০ শতাংশ। আর এক মাসে বেড়েছে দ্বিগুণ। এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়।

ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কমে যাচ্ছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। যেমন, অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রেমিট্যান্স কম এসেছিল প্রায় ২৮ শতাংশ। পরের মাস আগস্টে তা কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে কম এসেছে প্রায় ২০ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতা অক্টোবরে কমেছে ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ কারণে অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ২৫ শতাংশের ওপরে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৭০৪ কোটি ডলার, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৮৮১ কোটি ডলার। এর মধ্যে গত মাসে এসেছে ১৬৪ কোটি ডলার, যেখানে আগের অর্থবছরের অক্টোবরে ছিল ২১০ কোটি ডলার।

সূত্র জানায়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় অংশই রফতানি ও রেমিট্যান্স থেকে। ২ শতাংশ আসে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে। করোনার কারণে ঋণপ্রবাহ বাড়ায় এটি এখন ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রফতানি আয় বাড়লেও কমছে রেমিট্যান্স। ঋণপ্রবাহও এখন কমেছে। এ দিকে আমদানি ব্যয়সহ বিদেশে যাওয়ার খরচ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই অক্টোবরে রফতানি আয় বেড়েছে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ১ শতাংশের কম। গত সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৫০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে আন্তঃপ্রবাহ।

বাড়ছে ডলারের দাম : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়া এবং বিদেশে লোকজনের যাতায়াতের কারণে যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেড়েছে, সেভাবে আয় বাড়েনি। ফলে দেশের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়ে গিয়ে ডলারের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এতে হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। গত জুলাই থেকে দাম বাড়ছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। এক সপ্তাহ আগে ছিল ৮৫ টাকা ৬৫ পয়সা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ১৫ পয়সা। গত বছরের ১০ নভেম্বর ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ১ টাকা। শতকরা হিসাবে বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায় কিছু কিছু ব্যাংক ডলারের সংস্থান না করেই পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলছে। মূল্য পরিশোধের সময়ে পড়ছে বেকায়দায়। এ দিকে রেমিট্যান্স কমায় ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কমে গেছে। বাজারে ডলারের সঙ্কট থাকায় তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। এভাবেই চাপ বেড়ে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি না করলে ডলারের দাম আরো বেড়ে যেত। গতকাল শনিবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার লেনদেন হয়েছে ৮৫ টাকা ৬৭ পয়সায়। কিন্তু খোলা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা ৫০ পয়সার কাছাকাছি। মূলত ক্যাশ ডলার কমে যাওয়ায় খোলা বাজারে ডলারের দাম বাড়ছে বেশি হারে। সামনে এ অবস্থা আরো প্রকট বলে আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/622496