১ নভেম্বর ২০২১, সোমবার, ১০:৫১

জীবনবিনাশী মাদকের ভয়াবহতা

মাদকের নেশা সর্বনাশা। জীবনবিনাশী মাদক আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর থেকে শুরু করে সব শ্রেণীপেশার মানুষকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যা ভাবলেই রীতিমতো গা শিউরে ওঠে। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই মাদকের প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়। কিন্তু রমরমা বাণিজ্য বন্ধ হয় না। একশ্রেণীর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উচ্চবিত্ত নারীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কেউ কেউ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। হাত বাড়ালেই আইস, হেরোইন, গাঁজা, বিভিন্ন ধরনের মাদক পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি বছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস সারা বিশে^র মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মাদক বিষয়ে হই সচেতন, বাঁচাই প্রজন্ম, বাঁচাই জীবন’। দিবসটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মাদক সেবন, কারবার ও পাচারের অন্যতম রুট। চোখের সামনেই তরুণ প্রজন্মকে মাদক গিলে খাচ্ছে। কিন্তু প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।

ঢাকার অলি গলিতে মাদকের অবাধ বাণিজ্য চলছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশের বহু জায়গায় তরুণ-তরুণীদের মাদক সেবন করতে দেখা যায়। মাদকের ভয়াবহতা কত নিষ্ঠুর কত বেদনাদায়ক হতে পারে তা ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। তরুণরা দেশ ও জাতির সৃজনশীল পথের আলোর দিশারি। অথচ কিছু বিকারগ্রস্ত মানুষ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তরুণদের মাদকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে তারা নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক স্থিতিশীলতা। ভাঙছে অসংখ্য পরিবারের স্বপ্ন। মাদকের আগ্রাসনে শুধু পরিবার ধ্বংস হয় না। একটি দেশও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ চীন। ১৮৩৯ সাল থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত সময়ে চীন আর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন ও ফান্সের মধ্যে আফিম যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়। ব্রিটিশরা চীনে একচেটিয়াভাবে আফিমের ব্যবসা করত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আফিমের ব্যবসা ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়েছিল। চীন সরকার চোরাচালানের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করলেও ব্রিটিশ সরকার আফিম ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে চীনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে চীন হারলেও তাদের নৈতিক বিজয় অর্জিত হয়। চীনারা আফিমের কুফল অনুধান করতে পারে। মাদক কিভাবে একটি দেশ ও জাতিকে বিনষ্ট করে তা আফিম যুদ্ধের ইতিহাস পড়লেই বোঝা যায়। মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে চীন আজ বিশে^র পরাশক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতির ভয়াবহতা জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। যার মধ্যে ৮৭ ভাগ পুরুষ এবং ১৩ ভাগ নারী। এদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছর। ৬৫ শতাংশ অবিবাহিত এবং ৫৬ শতাংশ বেকার অথবা শিক্ষার্থী। এরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। ১ লাখের বেশি মানুষ নানাভাবে মাদক কারবারের সাথে জড়িত। দেশের বাইরে থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের মাদক আসছে।

মাদকের গডফাদার ও দাগি চোরাকারবারিরা হাজার কোটি টাকার মাদক দেশের ভেতরে নিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কঠোর শাস্তির কোনো নজির নেই। মাদকের অভিশপ্ত মারণনেশায় স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী তার স্বামীকে, সন্তান তার মা কিংবা বাবাকে খুন করছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে গত ১০ বছরে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে প্রায় ২০০ বাবা-মা নিহত হয়েছেন। মাদকসেবী স্বামীর হাতে ২৫০ জনেরও বেশি নারী প্রাণ হারিয়েছেন। এক পুলিশ অফিসার বাবা তারই কন্যার আঘাতে নিহত হয়েছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ঢাকার অলিতে গলিতে শুরু হয় মাদকের আড্ডা। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, হাতিরঝিল, মতিঝিল, বনানী, গুলশান, সদরঘাটসহ বিভিন্ন রেস্ট হাউজে চলছে মাদকের রমরমা কারবার।

সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় সম্পদ তরুণর। মেধা ও চরিত্র দিয়ে দেশকে যেখানে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা সেখানে তারা সর্বনাশা মাদকের নেশায় ঘৃণ্যকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার প্রয়াসে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেন তারা তাদের মূল্যায়ন করতে পারে। পারিবারিক সংস্কৃতির যে ব্যত্যয় ঘটেছে তা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় খেলাধুলার ব্যবস্থা, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, স্কুল-কলেজে বিতর্ক, আবৃত্তি, গল্প বলা, রচনা প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা লেখা ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তাদের উদ্যমশীল কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা দরকার। যেন তারা নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারে। এগুলো করতে পারলে তাদের বহুমুখী প্রতিভা পরিস্ফুটিত হবে। মাদকমুক্ত সমাজগঠনে আইনের পাশাপাশি নৈতিকতার প্রসার বাড়াতে হবে। শিক্ষা কারিকুলামে নৈতিক শিক্ষার প্রসার বাড়ানো, সিনেমা এবং নাটকে মাদক গ্রহণের দৃশ্য সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি এবং চাকরির নিয়োগপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে ডোপটেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে।

সরকার থেকে শুরু করে দেশের সুশীলসমাজ,বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান,সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকর ভূমিকাই পারে মাদকের ভয়াবহতা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ রিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/619526/