১ নভেম্বর ২০২১, সোমবার, ১০:৩৭

জলবায়ু উদ্বাস্তুর উচ্চ ঝুঁকিতে দেশের ২ কোটি মানুষ

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়বে, যা দেশের ৬৪টি জেলার জনজীবনে প্রভাব ফেলবে। নতুন একটি গবেষণা এমনটাই দাবি করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে ভয়াবহ এক ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বিশাল জনগোষ্ঠির গৃহহারা হওয়া। পরিণামে সৃষ্টি হবে আরেকটি বড় সমস্যা-জলবায়ু শরণার্থীর সমস্যা। বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার এক কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবেন। এই ধকল মোকাবিলায় কোপ-২৬ এ উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে তহবিলের প্রতিশ্রুতি আদায়ে আশাবাদী সরকার। এমন বাস্তবতায় গতকাল রোববার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হতে যাওয়া কপ সম্মেলনে বাংলাদেশ জলবায়ু তহবিলের ওপর জোর দেবে। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। ঝুঁকির মুখে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি জেলার মানুষ। মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা আগামী ৩০ বছরে ৭ গুণ বেড়ে যাবে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের আরো ২ কোটি মানুষ তাদের বাস্তুভিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ৪৫ জনের মধ্যে ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। আর বাংলাদেশে সংখ্যাটা হবে প্রতি সাতজনে একজন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশের প্রবৃদ্ধি চার শতাংশ কমে যেতে পারে। বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ক্লাইমেট রেফিউজি বা এসিআর, আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশন এইড এবং ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়ার সূত্রে এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

এদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হবে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ এ। তাতে বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দের পরিমাণ দুই হাজার ১৮৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। তবে করোনার কারণে আগের চেয়ে এই বরাদ্দ কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মেকাবিলায় বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। জলবায়ু এবং এর তহবিল নিয়ে কাজ করছে ২৫টি মন্ত্রণালয়। বাংলাদশে এ পর্যন্ত গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি থেকে ৪৩টি প্রকল্পে ১৬ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান পেয়েছে। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে নয় কোটি ৪৭ লাখ ডলার, ক্লাইমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড থেকে ১১ কোটি ডলার অর্থ পেয়েছে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে ১০৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার অনুদান পেয়েছে। আর সরকার প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে ১০০ কোটি ডলার ব্যয় করছে রাজস্ব খাত থেকে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের অন্যান্য ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের মানুষকেও ভাবিয়ে তুলেছে। বালি, বন, কোপেনহেগেন কোনো সম্মেলনেই সঠিক অর্থে এর প্রতিকার উঠে আসেনি। অথচ প্রতিনিয়তই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে অত্যন্ত দ্রুত। এছাড়া, আর্কটিক অঞ্চলে বরফ গলে যাওয়া, সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা, নদী ভাঙ্গন, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির ফলে মানুষ জলবায়ু শরণার্থী অথবা পরিবেশ-উদ্বাস্তু বা অভিবাসীতে পরিণত হচ্ছে। বাধ্য হচ্ছে বাস্তুভিটা ত্যাগ করতে, দেশান্তরী হতে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সেমিনারে বলেছেন, বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ এরইমধ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন। সমূদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানির লবণাক্ততা বাড়া, নদী ভাঙ্গন এবং ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার অভিঘাতে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব জানাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন স্থায়ীভাবে। এই সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মতো। তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু।

বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) আহ্বায়ক নুর আলম শেখ গণমাধ্যমকে বলেন, লবনাক্ততা বাড়ছে। বাড়ছে নদী ভাঙন। যা প্রাণ ও প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কৃষি নির্ভর এলাকার মানুষ কাজ হারিয়ে শহরে যাচ্ছেন কাজের খোঁজে। কেউ যাচ্ছেন একা আবার কেউ সপরিবারে। তারা শুধু ঢাকা নয় অন্য শহরেও যাচ্ছেন কাজের খোঁজে।
খ্যাতিমান পরিবেশবিদ ও জলবায়ু গবেষক ড. আতিক রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, যারা জলবাযুর এই ক্ষতির জন্য দায়ী তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। শুধু গরিব মানুষ নন, ধনীরাও এর শিকার হচ্ছেন। খাবার পানির সংকট সবাইকে বিপর্যস্ত করছে। লবণ পানির কারণে এই এলাকায় প্রতি তিনজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় গতকাল রোববার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হতে যাওয়া কপ সম্মেলনে বাংলাদেশ জলবায়ু তহবিলের ওপর জোর দেবে।

বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরির্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. সাহাবুদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, এবার আমরা ফান্ড ভালো পাবো বলে আশা করি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যারা পরিবেশের ক্ষতি করছে সেই দেশগুলোর প্রতি বছর এক লাখ মিলিয়ন ডলার করে দেয়ার কথা। এইবার আশা করছি তারা এটা দিতে সম্মত হবেন।

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ঢাকার পরিচালক সলিমুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, গবেষণায় অভিবাসনের ব্যাপারে উদ্বাস্তু মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে মানুষের জটিল আচরণের দিকে সঠিকভাবে ফোকাস করা হয়েছে। ঢাকা ছাড়া দেশের বড় শহরগুলোতে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের গ্রহণের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর একটি নতুন ডাটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন চালু করেছে। এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কীভাবে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং যারা এরই মধ্যে এ কারণে উদ্বাস্তু হয়েছেন তাদের জীবন কতটা ঝুঁকির মুখে রয়েছে, তা জানা সম্ভব হচ্ছে। নতুন ডাটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এর নাম দেয়া হয়েছে, ডিসপ্লেসড অন দ্য ফ্রন্টলাইনস অফ দ্য ক্লাইমেট এমারজেন্সি। ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে জানায়, এর মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যসব হুমকির কারণে গৃহহীন হচ্ছে মানুষ এবং যারা এরই মধ্যে উদ্বাস্তু হয়েছেন, তাদের জীবন কতটা ঝুঁছকির মুখে রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম এবং বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দারিদ্র্য হার সবচেয়ে বেশি। ১৯টি উপকূলীয় জেলায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে এক কোটি ১৮ লাখ। আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশন এইড এবং ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়ার গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ ও ভয়াবহ প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে বাস্তুভিটা ছেড়ে দিতে হবে। ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সদ্য সমাপ্ত অপর এক গবেষণার ফলাফলে বলেছে, বাংলাদেশের ২ কোটিরও বেশি মানুষ ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে ৪ দফার বন্যায় জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিস্থিতি ছিল নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের।

https://dailysangram.info/post/469811